জীবন মানোন্নয়ন ও ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করছে মোবাইল ইন্টারনেট: টেলিনরের সমীক্ষা

সম্প্রতি, এশিয়ার আটটি দেশে আট হাজার মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে টেলিনর এশিয়া। টেলিনরের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এ সমীক্ষা চালানো হয়। ‘ডিজিটাল লাইভস ডিকোডেড’ শীর্ষক এই সমীক্ষার ফলাফলে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে পাঁচটি বিষয় তুলে ধরা হয়। সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, ‘অলওয়েজ-অন’ অর্থাৎ সবসময় সক্রিয় থাকবেন, এমন জীবন যাপন করার
ইচ্ছা প্রকাশ করেন বেশিরভাগ মানুষ। বাংলাদেশের ৯১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন মোবাইল ব্যবহার করার মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটেছে। সবমিলিয়ে এ ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আছেন; এই অঞ্চলে জীবনের মান বিশেষভাবে উন্নত হয়েছে প্রসঙ্গে, ৫২ শতাংশ পুরুষের তুলনায় ৬৩ শতাংশ নারী ইতিবাচক জবাব দিয়েছেন। এছাড়াও, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের কারণে তাদের জীবনমান উন্নত হয়েছে মনে করেন ৫৯ শতাংশ নারী এবং ৫০ শতাংশ পুরুষ।

সমীক্ষার ফল প্রকাশে ১৮ অক্টোবর গ্রামীণফোন স্থানীয় একটি হোটেলে  অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে মূলবক্তব্য প্রদান করেন গ্রামীণফোনের চেয়ারম্যান ও টেলিনর এশিয়ার প্রধান ইয়র্গেন সি. অ্যারেন্টজ রোস্ট্রাপ। ব্যবহারকারীদের জন্য আরও বেশি অর্থনৈতিক সুযোগ, দৈনন্দিন সুবিধা ও প্রয়োজনীয় সেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে কি-ট্রেন্ডগুলোর সাথে কীভাবে কানেক্টিভিটি সম্পর্কিত, তা মূল বক্তব্যে তুলে ধরেন তিনি। মূল্য বক্তব্যের পর একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত ফলাফলগুলোর ওপর আলোচনা  করেন গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী ইয়াসির আজমান, বাংলাদেশে ইউএনডিপি’র ডেপুটি আবাসিক প্রতিনিধি ভ্যান নুয়েন এবং চাইল্ড হেলথ
রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। গ্রামীণফোনের চীফ বিজনেস অফিসার ড.আসিফ
নাইমুর রশিদ প্যানেল ডিসকাসন পরিচালনা করেন।

গ্রামীণফোনের চেয়ারম্যান ও টেলিনর এশিয়ার প্রধান ইয়র্গেন সি. অ্যারেন্টজ রোস্ট্রাপ বলেন, “অনেকে ক্ষেত্রেই শোনা যায়, মোবাইল ডিভাইস মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছে, আশপাশের বিষয় থেকে তাদের নিরুৎসাহিত করছে এবং সম্পর্ক ও পারস্পরিক যোগাযোগ দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কিন্তু এই সমীক্ষা আমাদের অন্যরকম ধারণা দিচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারির আগের সময়ের তুলনায় এশিয়ার দেশগুলোতে মোবাইল ডেটা ব্যবহারের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে, যা ঘরে-বাইরে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এ ব্যবধান বুঝতে পারা নীতি-নির্ধারক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল বৈষম্য কোথায় রয়েছে তা এই সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে। এই সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।”

গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী ইয়াসির আজমান বলেন, “সমাজের ক্ষমতায়ন গ্রামীণফোনের মূল লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্যপূরণে কানেক্টিভিটির মাধ্যমে ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে নিয়ে আসতে গ্রামীণফোন ২৫ বছর ধরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, আমাদের প্রচেষ্টার কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও আর্থিক সেবার ক্ষেত্রে মোবাইল প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে; নগর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। পাশাপাশি, আমরা ডিজিটালভাবে দক্ষ ও বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারবে এমন জনশক্তির মাধ্যমে একটি দারিদ্রমুক্ত, জ্ঞান-নির্ভর এবং স্বনির্ভর অর্থনীতি অর্জন করতে আমাদের লক্ষ্যকে পরিচালিত করতে পেরেছি।”

গবেষণা থেকে প্রাপ্ত বিষয়সমূহ:

১। আঙুলের ছোঁয়ায় জীবন – অলওয়েজ অন!

প্রায় সব উত্তরদাতাই বলেছেন যে, দিনের একটি উল্লেখযোগ্য সময়জুড়ে তারা তাদের ফোন তাদের সাথেই রাখেন, যেখানে প্রতি পাঁচ জনে জানিয়েছেন তিনি কখনই ফোন ছাড়া থাকেন না। তবে, শতকরা প্রায় ৭১ ভাগ বাংলাদেশি উত্তরদাতারা বিশ্বাস করেন তারা প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভারসাম্য বজায় রেখে চলেন। বাংলাদেশে শতকরা ৯১ ভাগ ব্যবহারকারী দিনের অন্তত অর্ধেক সময় তাদের ফোন ব্যবহার করেন, অন্যদিকে ২০ শতাংশ উত্তরদাতা সবসময় তাদের ফোন ব্যবহার করেন বলে জানান।

শতকরা ৭৩ ভাগ বাংলাদেশি জানিয়েছেন আগামী ১২-২৪ মাসে তাদের মোবাইল ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে এবং বিগত দুই বছরে দেশে এই ডিজিটাল রূপান্তরের গতি কমে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।

২। ডিজিটাল জীবনযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে চলা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন বাংলাদেশিরা

এ অঞ্চলের শতকরা ৮৫ ভাগ উত্তরদাতা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বিকাশের বিষয়ে চিন্তিত। বাংলাদেশী উত্তরদাতাদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ এ ব্যাপারে শঙ্কিত। এই উদ্বেগ অল্পবয়সী উত্তরদাতাদের মাঝে আরো বেশি স্পষ্ট – যেখানে শতকরা ৬৮ ভাগ জেন জি’র উত্তরদাতা এবং শতকরা ৬৯ ভাগ মিলেনিয়াল উত্তরদাতারা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

৩। ডিজিটাল পরিসরে আস্থার (অভাব)

পুরো অঞ্চলজুড়ে মোবাইল ডিভাইসের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে (বাংলাদেশি উত্তরদাতাদের হার ৯৭ শতাংশ)। বাংলাদেশে বেবি বুমারদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে জীবনের মানে উল্লেখযোগ্য উন্নতির কথা স্বীকার করার হার সবচেয়ে বেশি (৭১ শতাংশ)। একইসাথে তারা এই ব্যবহারের সাথে সম্পৃক্ত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়েও সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন (৮৯ শতাংশ)। পুরো অঞ্চলজুড়ে অন্য স্থানে জেন জি এবং মিলেনিয়াল উত্তরদাতারা জানিয়েছেন তারা ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা এবং অনলাইন নিরাপত্তার নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।

৪। টেকসই জীবনযাপনে মোবাইলের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা

টেকসই জীবনযাত্রার প্রসঙ্গটি বর্তমান যুগে ক্রমশই প্রতীয়মান হয়ে উঠছে। সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে,
মানুষ আরও টেকসই জীবনযাপনের সহায়ক হিসেবে মোবাইল প্রযুক্তির সম্ভাবনার ব্যাপারে আশাবাদী।
শতকরা ৭৪ ভাগ বাংলাদেশি উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন, ডিজিটাল অ্যাক্সেস একটি পরিবেশ-বান্ধব জীবন
যাপনের জন্য অত্যন্ত উপকারী। শতকরা ৬৯ ভাগ বাংলাদেশি উত্তরদাতা মনে করেন, কাগজ, বর্জ্য এবং
বিদ্যুতের ব্যবহারে সাশ্রয়ী হলে এবং যোগাযোগকে আরো স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুললে সবচেয়ে বেশি সুবিধা
পাওয়া যাবে (৭৪ শতাংশ)।

৫। ডিজিটাল বৈষম্য দূর করছে মোবাইল প্রযুক্তি

সমীক্ষায় মোবাইল ব্যবহারের বৃহত্তর সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তরদাতারা বিশ্বাস
করেন, মোবাইল কানেক্টিভিটি অন্তর্ভুক্তি প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মোবাইল
কানেক্টিভিটি সাধারণের জন্য শিক্ষা (৬৪ শতাংশ) এবং স্বাস্থ্যসেবার (৫৫ শতাংশ) মতো প্রয়োজনীয়
সেবা প্রাপ্তি আরো সহজলভ্য করে। উল্লেখ্য, আমরা আরও দেখতে পেয়েছি যে, পুরুষদের তুলনায় অনেক
বেশি নারী মনে করেন মোবাইল সংযোগ তাদের কর্মসংস্থান এবং উপার্জনের বিকল্পগুলো উন্নত করেছে।
সেইসাথে এটি তাদের দৈনন্দিন জীবনে আরও বেশি দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা অর্জনে সহায়তা করেছে।
ইয়র্গেন সি. অ্যারেন্টজ রোস্ট্রাপ আরও বলেন “মোবাইল কানেক্টিভিটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য
আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে; তবে, এ বিষয়ে সঠিক দক্ষতা ও সচেতনতার অভাব – যেমন নিরাপত্তা ও

গোপনীয়তা সংক্রান্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা সংযোগের বাইরে থাকা এখন আমাদের জন্য স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানের মতো সুযোগগুলো সীমিত করে তুলতে পারে। ডিজিটাল খাতে আমাদের ঘাটতিগুলো কী এবং কীভাবে সে ঘাটতিগুলো পূরণ করা যায়, তা আমাদের জানতে হবে। সেইসাথে আমাদের অনলাইন কার্যক্রমগুলোর কার্বন ফুটপ্রিন্টের ব্যাপারে জানতে হবে। কেননা, আমরা একটি ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে একসাথে কাজ করছি, যেখানে মোবাইল সংযোগ সকলের জন্য টেকসই ভূমিকা রাখবে ও ক্ষমতায়নে সহায়ক হবে।”





About লেখাপড়া বিডি ডেস্ক 1519 Articles
লেখাপড়া বিডি বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা বিষয়ক বাংলা কমিউনিটি ব্লগ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*