বিসিএস উত্তীর্ণদের চাকরি দিন

বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (বিপিএসসি) দেশের একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি দেশের নাগরিকদের মধ্য থেকে কর্মে নিয়োগের জন্য জনবল বাছাই করে থাকে। দীর্ঘকাল ‘বেকারবান্ধব’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম কুড়িয়ে থাকলেও সম্প্রতি গৃহীত এক নীতিমালায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করছে দেশের চাকরি প্রত্যাশী তরুণ সমাজ। নবপ্রণীত এ নীতিমালাকে সংবিধানের ‘অনুচ্ছেদ ২৯’ বিরোধী আখ্যায়িত করে এর বাতিল পূর্বক নন ক্যাডার সুপারিশের দাবি তুলেছে বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীরা।

গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা আনতে ক্যাডার ও নন ক্যাডার পদে একই সাথে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিপিএসসি। আগামী ৩০ নভেম্বর ৪৫ তম বিসিএস এর আসন্ন বিজ্ঞপ্তিতেই এ নিয়ম কার্যকর হবে বলে জানা গেছে। এজন্য বিজ্ঞপ্তিতেই বিভিন্ন ক্যাডারের পদ সংখ্যার মতো নন ক্যাডার শূন্য পদ সমূহ উল্লেখ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফলে আসন্ন ৪৫ তম বিসিএস এর জন্য নন ক্যাডার পদ সংরক্ষণ করা বিপিএসসির জন্য নতুন এক চাপ। চলতি বছরের গত ১৯ সেপ্টেম্বর একটি সরকারি দপ্তরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠিতে দেখা যায়, বিসিএস পরীক্ষার সার্কুলারের সময়কাল ভিত্তিতে ৪০, ৪১, ৪৩, ৪৪ এবং ৪৫ তম বিসিএস এর জন্য নন ক্যাডার শূন্য পদ পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে। সরকারি কর্ম কমিশনের নতুন সিদ্ধান্তের সুপারিশেই এমনটি করা হয়েছে।

নতুন নীতিমালা অনুসারে, ‘‘কোনো বিসিএসএর সার্কুলার প্রকাশের দিন থেকে পূর্ববর্তী শূন্যপদ সমূহ ঐ বিসিএস এর জন্য রাখা হবে।’’ এদিকে ৪০ তম বিসিএস এর সার্কুলার প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। বাছাই
পরীক্ষার সকল প্রক্রিয়া শেষে দীর্ঘ সাড়ে ৩ বছর অতিক্রম করে এর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হয়। এ ফলাফল ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত পূর্ববর্তী ৩৮ তম বিসিএস নন ক্যাডার সুপারিশ করা হয়েছে। ফলে ৪০ বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের
পূর্ববর্তী অধিকাংশ পদই ৩৭, ৩৮ তম বিসিএস নন ক্যাডার প্রার্থীদের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ বিধিমালা ২০১০ (সংশোধিত ২০১৪) এর বিধি ৫ এর উপ-বিধি ৩ অনুসারেই এ সুপারিশ করা হয়েছে। নন-
ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা ২০১০ (সংশোধিত ২০১৪) এর বিধি ৫ এর উপ-বিধি ৩ অনুসারে, ‘‘একটি বিসিএস এর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর থেকে পরবর্তী বিসিএস এর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত উত্তীর্র্ণদের
মধ্য থেকে নন ক্যাডার পদে সুপারিশ করবেন।’’ পূর্ববর্তী এ বিধি অনুসারেই চলমান ৪০, ৪১, ৪৩ এবং ৪৪ বিসিএস এর কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়াই উচিৎ।

নতুন নীতিমালা কার্যকর করলে পূর্ববর্তী নিয়ম অনুসারে শুরু হয়ে মাঝপথে থাকা ৪০, ৪১, ৪৩ এবং ৪৪তম বিসিএস এ অংশগ্রহণকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। বিশেষ করে ৪০ তম বিসিএস উত্তীর্ণ নন ক্যাডার প্রত্যাশী প্রার্থীরা
পদবঞ্চিত হবেন। নিয়মানুসারে, ৪০ তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর থেকে ৪১ তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত প্রাপ্ত নন ক্যাডার (৯ম থেকে ১২ তম গ্রেড) শূন্য পদ সমূহ ৪০ তম বিসিএস এ উত্তীর্ণদের জন্য। কিন্তু শেষ প্রান্তে এসে ‘অযৌক্তিকভাবে’ নতুন নিয়মের ফাঁদে পরতে হচ্ছে ৪০ তম বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীদের। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ৪০ তম বিসিএস প্রার্থীদের জন্য শেষ প্রান্তে এসে নতুন নীতিমালা কার্যকর করা অন্যায় বলে মনে করছেন চাকরি প্রত্যাশীরা। আর এই অন্যায়টা হতে যাচ্ছে চলমান ৪০, ৪১, ৪৩ এবং ৪৪ তম বিসিএস প্রার্থীদের প্রতি। কারণ, চলমান বিসিএস গুলোতে নতুন নিয়ম কার্যকর করলে প্রার্থীরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নন ক্যাডার পদ থেকে বঞ্চিত হবে। ১৫০০ নম্বরের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও খালি হাতে ফিরতে হবে তাদের। এতে একদিকে যেমন পূর্ববর্তী বিধিমালার ব্যত্যয়, অন্যদিকে প্রায় ৮৫ হাজার শূন্য পদ থাকা সত্বেও বেকার তরুণদের বঞ্চিত করা। পূর্বের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে চলমান বিসিএস গুলোর জন্য নতুন নিয়ম কার্যকর করলে সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘সুযোগের সমতা’ লঙ্ঘিত হবে।

দেখা যায়, বিসিএস নন ক্যাডার নীতিমালা কার্যকরের পর ২৮ তম বিসিএস থেকে ২৯৯ জন, ২৯ তম বিসিএস থেকে ১৯৩ জন, ৩০ তম বিসিএস থেকে ৩৬৩ জন, ৩১ তম বিসিএস থেকে ১২০ এবং ৩২ তম বিসিএস থেকে মাত্র ৬৬ জন প্রথম শ্রেনীর নন ক্যাডার পদে নিয়োগ পান। শুরু থেকে নন ক্যাডারে শুধু প্রথম শ্রেনীর পদ অন্তর্ভূক্ত করায় চাহিদা এবং শূন্য পদ সংখ্যা কম ছিল। ফলে ২৮ তম থেকে ৩৩ তম বিসিএসে উত্তীর্ণ এমন প্রায় ১৯ হাজার বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীকে শূন্যহাতে ফিরতে হয়েছে। পরবর্তীতে ২০১৪ নন ক্যাডার পদে সুপারিশের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির পদেও (১২ তম গ্রেড পর্যন্ত) নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এই ধারাবাহিকতায় ৩৪ তম বিসিএস থেকে ৩৮ তম বিসিএস পর্যন্ত নন ক্যাডার
পদের সুপারিশ করা হয়ে আসছে। দেখা যায়, ৩৪ তম বিসিএস এ ১৮০২ জন, ৩৫ তম বিসিএস এ ২১৪৪ জন, ৩৬ তম বিসিএস এ ১২৬১ জন, ৩৭ তম বিসিএস এ ১৭২৪ জন এবং ৩৮ তম বিসিএস এ ৩৩০২ জনকে নন ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। সর্বশেষ ৪০ তম বিসিএস থেকে ৮১৬৬ জন প্রার্থীকে নন ক্যাডার পদের জন্য অপক্ষেমাণ তালিকায় রাখা হয়েছে।

লক্ষ্যণীয় যে সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের চাহিদার প্রেক্ষিতে শূন্য পদ এবং নন ক্যাডারে নিয়োগের সংখ্যা বেড়েছে। এর যথেষ্ট যৌক্তিকতাও রয়েছে। বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর মধ্য থেকে বাছাই শেষে উত্তীর্ণ স্বল্প সংখ্যক ক্যাডার পদের সাথে কয়েক হাজার নন ক্যাডার প্রার্থীকে সুপারিশ করাই যৌক্তিক। এতে বিভিন্ন দপ্তরের অল্প সংখ্যক পদের জন্য বার বার সার্কুলার প্রকাশ, পরীক্ষা নেয়া সহ নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতা ও দীর্ঘ সূত্রিতা পোহাতে হয় না।
চলমান শিক্ষা ব্যবস্থায় স্নাতক শেষ করতে শিক্ষার্থীদের ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়স অতিক্রম হয়। চাকরিতে আবেদনের বয়স সীমা ৩০ বছর হওয়ায় একজন প্রার্থী তিন থেকে পাঁচটি বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করতে পারেন। আর স্বপ্ন পূরণের এ পথে অনেকেরই একবারে সফলতা আসে না। যৌবনের মহা মূল্যবান সময়টুকু দিয়ে স্বপ্ন দেখেন একটি সরকারি চাকরির জন্য। নতুন নীতিমালা এখনই কার্যকর করলে ৪০ থেকে ৪৫ তম এ পাঁচটি বিসিএস এর জটিলতায় অনেক প্রার্থীরই স্বপ্নভঙ্গ হবে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর ও কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য অনুসারে দেশে ৯ম থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত এক লক্ষের কাছাকাছি শূন্য পদ রয়েছে। পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে প্রত্যেকটি দপ্তরে কাজের চাপ এবং অসম্ভব ধীরগতি লক্ষ্যণীয়। এসব সংকট
নিরসনে নন ক্যাডার পদে বিপিএসসি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থীকে সুপারিশ করাই সময়ের দাবি। চলমান সংকট নিরসণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারেন যেমন- পূর্বের নীতিমালা অনুসারে দওুততম সময়ে ৪০, ৪১, ৪৩ ও ৪৪ তম বিসিএস সম্পন্ন করা; নন ক্যাডার পদের পরিসর বৃদ্ধি করা এবং বিভিন্ন
মন্ত্রণায়, বিভাগ ও অধিদপ্তরে সাময়িক নিয়োগ নিষিদ্ধ করে নন ক্যাডার থেকে সুপারিশ করা; যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে সমন্বিত নিয়োগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং একটি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে অধিকাংশ দপ্তরের জনবল সরবরাহ নিশ্চিত করা।

এতে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে বিসিএস উত্তীর্ণ মেধাবী তরুণরা নিয়োগ পাবেন। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে এগিয়ে যাবে দেশ। জনসংখ্যার বোনাস কালের (ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ট) কার্যকর সুফল অর্জন সম্ভব হবে। একটি বৈষম্যহীন, সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সরকারি কর্মকমিশন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। শিক্ষিত তরুণদের অন্যতম আশ্রয়স্থল হিসেবে কর্মকমিশন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।





About mdmusaju 9 Articles
তিনি একজন কলামিস্ট ও সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*