গ্রন্থ সমালোচনা: ‘আমাদের অর্থে আমাদের পদ্মা সেতু’

পর্যন্ত পদ্মা সেতুকে নিয়ে যতগুলো গ্রন্থ বের হয়েছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হচ্ছে: ‘আমাদের অর্থে আমাদের পদ্মা সেতু’। সুসম্পাদিত এ গ্রন্থখানি সম্পাদনা করেছেন বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। গ্রন্থটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুটো ভাষণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের ৫১টি প্রবন্ধ রয়েছে। ছড়া-কবিতা রয়েছে দশটি ও গান রয়েছে দুটি। একটি প্রামাণ্য ঘটনাপ্রবাহ রয়েছে। পাশাপাশি চারটি সাক্ষাৎকার রয়েছে এবং অ্যালবামে বেশকিছু দুর্লভ চিত্র রয়েছে।

গ্রন্থখানি ব্যতিক্রমধর্মী হিসেবে পাঠকদের কাছে হৃদয়গ্রাহী হয়ে ধরা দেয়। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাঙালি জাতির সৃজনশীল ও ধীশক্তিসম্পন্ন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অসামান্য নেত্রী। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি পদ্মা সেতু নির্মাণের কারিগর ও স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি বলেছেন যে, ‘বাঙালি জাতি বীরের জাতি। বাঙালি ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রঞ্জিত হয়েছে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, অনেক রক্তধারায়’ (পৃ: ২৮)।

একটি কথা না বললেই নয়, বাংলা একাডেমির বাংলা অভিধানের সংস্কার প্রয়োজন। যেমন- অভিধান অনুসারে আজকাল উপলক্ষকে লেখা হয় উপলক্ষ্য। জোর দাবি জানাব, বাংলা একাডেমি বাংলা অভিধানের সংস্কার সাধন করা হোক। এ জন্য নতুন করে সংশোধনী কমিটি তৈরি করা উচিত।

এস এ মালেকের প্রবন্ধ ‘ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বপ্নজয়ের পদ্মা সেতু’ অত্যন্ত চমৎকার হয়েছে। তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে লিখেছেন যে, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্র পরাভূত হয়’ (পৃ: ৪৪)। প্রফেসর আব্দুল খালেকের সময়োপযোগী উচ্চারণ, ‘আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাঙালির গর্বের আরেকটা নতুন সংযোজন পদ্মা সেতু’ (পৃ: ৫৪)।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ মন্তব্য করেছেন যে, ‘বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ এবং বাংলার মানুষের মর্যাদা উত্তরোত্তর আরও সমুন্নত হোক’ (পৃ: ৬৮)। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উল্লেখ করেছেন যে, ‘এ দেশ নিজের অর্থায়নে এত বিশাল সেতু নির্মাণ করতে পারলে ধীরে ধীরে আরও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিজ অর্থেই সম্পন্ন করতে পারবে’ (পৃ: ৯২)।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন যথার্থ অর্থে মন্তব্য করেছেন যে, ‘শেখ হাসিনা পুরো বিশ্বকে প্রমাণিত করে দিয়েছেন যে, আমরা জাতি হিসেবে কতটা শক্তিশালী’ (পৃ: ৯৯)। সৈয়দ আবুল হোসেন তার কর্মকাণ্ড এবং তার প্রতি অন্যায় ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, ‘দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে তা ৯ বছর পিছিয়ে গেল’ (পৃ: ১২৮-১২৯)।

ড. শরীফ এনামুল যথার্থ অর্থে উচ্চারণ করেছেন যে, ‘কাজেই এটা প্রমাণিত, বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় শেখ হাসিনার বিকল্প নেতৃত্ব মেলা ভার’ (পৃ: ১৭২)। মোশারফ হোসেন ভুইয়ার প্রতি মিথ্যা অভিযোগের কারণে যে হেনস্তা হয়েছে সেটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। ষড়যন্ত্রকারীরা কখনো থেমে থাকে না। তাই তো দেখা যায় যে, সুভাষ সিংহ রায় তার প্রবন্ধে যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, ‘দেশের মানুষ দেখেছে, পদ্মা সেতু নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হয়েছে, বাধা এসেছে; শেষ পর্যন্ত সত্যেরই জয় হয়েছে’ (পৃ: ২৬৪)।

নিজের প্রবন্ধটি সম্পর্কে কোনো মন্তব্যে যাচ্ছি না। কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার কবিতাখানি হৃদয় ছুঁয়েছে- যার থেকে চারটি পঙক্তি পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরি। সোনার দেশে সোনার মানুষ উড়াল সেতু ধরি/ আসা যাওয়ার পথে কুড়ায় সোনার কড়ি/ আলোর দেশে আলোর সেতু হাসছে আঁধার চিরে/ও নদী রে, পদ্মা নদী রে/ (পৃ:৩৪৯)।

সৈয়দ আবুল হোসেনের সাক্ষাৎকারখানি তথ্যবহুল। অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার থাকলে ভালো হতো। অ্যালবামের চিত্রগুলো অত্যন্ত চমৎকার। আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমানের লেখাটিও সুন্দর হয়েছে। জাতি গ্রন্থের সুসম্পাদনার জন্য এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। এ গ্রন্থটির একটি ইংরেজি অনুবাদসহ বিভিন্ন ভাষায় হওয়া উচিত।

পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলা একাডেমির বাংলা অভিধানের সংস্কার সাধন করা উচিত। কেবল ব্যাকরণনির্ভর অভিধান নয়। নতুন বাংলার নীতিমালা অনেক ক্ষেত্রেই বেমানান। এ বানান বর্তমানে সাধারণ মানুষের কাছে গলার ফাঁস হচ্ছে। অথচ বাংলা একাডেমির বোধোদয় হচ্ছে না।

অভিনন্দন জানাচ্ছি এ পর্যন্ত প্রকাশিত পদ্মা সেতু নিয়ে রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এ কে আব্দুল মোমেন কর্তৃক রচনা করার জন্য। সাথে সাথে সহযোগী সম্পাদকদ্বয় দেবাশীষ দেব ও ইমদাদুল হককে ধন্যবাদ জানাই। পাশাপাশি সময়োপযোগী গ্রন্থ প্রকাশনার জন্য চন্দ্রাবতী একডেমীকে ধন্যবাদ এবং প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষকে ধন্যবাদ।

আলোচনায় দুটো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা স্মরণ করছি: ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিক্স থেকে ‍উদ্যোক্তা অর্থনীতির ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষিকাদের নিয়ে গত বছরে ফিল্ড ট্রিপে যাই। সেখানে আমরা দেখেছি চমৎকারভাবে পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রক্রিয়া এগিয়ে চলা এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। পরবর্তী সময়ে সরকারের প্রয়াসের একটি গবেষণাপত্র তৈরি করা হয় এবং ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিক্স হাইব্রিড পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়।

আবার চলতি বছরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে শরীয়তপুরে প্রোগ্রাম থাকায় যেতে গেলে সাড়ে তেরো ঘণ্টা মাওয়া ঘাটে কতিপয় ফেরিঘাট-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত লোকদের কারণে আটকে থাকি। এমনকি রাত একটার দিকে ফেরিতে যাওয়ার সিগন্যাল দিলে পার্শ্ববর্তী গাড়িতে এসে ঠিক সন্ত্রাসীর মতো একটি কাভার্ডে এক লোক ঝাঁপিয়ে আমার ভাড়া করা গাড়িতেও থাপ্পড় মারে। আজ পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ায় সেই দুর্নীতিবাজরা তাদের ক্ষমতা দেখাতে পারবে না- যা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইতে হুঁশিয়ার করেছেন। সম্প্রতি আমার প্রিয় নেত্রীও সরকারি চাকুরেদের জনগণের পাশে দাঁড়াতে বলেছেন।

অথচ ১৭ মার্চ ২০২২-এর সকালটি কী অপূর্ব কেটেছিল। এটিএন বাংলায় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে আমার লেখা গানটি প্রচারিত হয়েছিল এবং গ্লোবাল নিউজের প্রথম পাতায় বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে যখন জানালাম হার্টের অসুখের কথা- ভাবলেশহীন হলো, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার একই উক্তি। ধরণী দ্বিধা হও।

আসলে আমাদের উন্নয়নের রূপরেখার মালিক হচ্ছেন শেখ হাসিনা- যিনি সূর্যের আলোর মতো আলোকিত করে চলেছেন। ধন্যবাদ গ্রন্থের সম্পাদক এ কে আব্দুল মোমেনকে। গ্রন্থটি এতই চমৎকার হয়েছে যে, বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়া উচিত। বাংলা একাডেমি কি পারবে এ ধরনের অনুবাদের কাজ করতে? ভুল ও সাধারণ মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য বাংলা একাডেমির বাংলা অভিধান। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের উচিত দেশের মৌখিক ভাষাকে অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করা।

একটি সুন্দর গ্রন্থ সম্পাদনা আমাদের মুগ্ধ করেছে। পাঠক হিসাবে হৃদয়কে সমৃদ্ধ করেছে। অভিনন্দন গ্রন্থের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। এটি একটি জাতীয় ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা।

‘আমাদের অর্থে আমাদের পদ্মা সেতু’ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। প্রকাশক: চন্দ্রাবতী একাডেমী, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ, প্রকাশকাল: জুলাই, ২০২২, মূল্য: ২০০০ টাকা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪০০।





About প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী 25 Articles
তিনি একজন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাসংক্রান্ত বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, আইটি ও উদ্যোক্তা বিশেষজ্ঞ। এছাড়াও তিনি সাবেক উপাচার্য প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*