শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ত্রিবাঙ্কুরে রাজা রবিবর্মা যখন শিল্পকর্মে রত ছিলেন তখন বাঙলাদেশে ঠাকুর পরিবারের গ্রুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ খেয়ালখুশীমত চিত্রসাধনায় রত ছিলেন। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে প্রায় কুড়ি বৎসর বয়সে তিনি চিত্রশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি প্রথম একটি নারিকেল গাছ ও ল্যাম্প পোস্টের চিত্রাঙ্কন করেছিলেন বলে জানা যায়। প্রথমজীবনে সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন, তারপর তৎকালীন সরকারী-শিল্পবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যক্ষ পামার (Palmer) সাহেবের কাছে পেন্সিল স্কেচ (Pencil Sketch) ও কালিকলমের (Pen & Ink-এর) চিত্রাঙ্কন শিক্ষা করেন। ইংরাজ শিল্পী পামারের নিকট মাত্র ছয়মাস কাল তিনি পাঠগ্রহণ করেছিলেন, তারপর গলার্দি (Gillardi) নামক অপর এক ইটালীয় শিল্পীর নিকট ইওরোপীয় পদ্ধতিতে প্যাস্টেল (Pastel), কালিকলম, পেন্সিল ও কিছু কিছু তেলরঙে চিত্রাঙ্কন শিক্ষা করে ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ ইওরোপীয় চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি আয়ত্ত করেন।

একসময় কোনো এক আত্মীয়ের নিকট তিনি রাজপুত চিত্রের একখানি চিত্রসংগ্রহ উপহার পান। ঐ লক্ষ্ণৌ কলমের চিত্রগুলি অবনীন্দ্রনাথকে অত্যন্ত প্রভাবিত করে। তখন তিনি চণ্ডীদাসের পদাবলী অবলম্বন করে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকার বিষয় নিয়ে প্রায় কুড়িখানি চিত্র অঙ্কন করেন।এই চিত্রগুলিতে তাঁর সদ্যশিক্ষাপ্রাপ্ত ইওরোপীয় চিত্রবিদ্যার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল। এই চিত্রগুলি পরম ভক্ত ও বৈষ্ণব শিশির ঘোষকে যখন দেখান হয় তখন তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন— শ্রীরাধার কোনে৷ ‘কনুশেপশান’ চিত্রগুলিতে পাওয়া যায় না। ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে এই চিত্রগুলি অঙ্কিত হয়। অধ্যাপক হ্যাভেল কিন্তু এতে নূতন চিত্ররীতির ইঙ্গিত পেয়ে প্রশংসা করেছিলেন । এই সময় আর্টস্কুল-এর অধ্যক্ষ মনীষী হ্যাভেল শিশির ঘোষের নিকট অবনীন্দ্রনাথের শিল্পসাধনার সংবাদ পেয়ে, তাকে ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে আর্টস্কুলের সহকারী অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করেন এবং নিয়মিতভাবে ভারত-শিল্পের পু‘থিপত্র পড়িয়ে ও প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর্য, চিত্র প্রভৃতির নানা নিদর্শন দেখিয়ে তাকে ভারতীয় রীতিতে চিত্রাঙ্কনে উৎসাহিত করেন । স্কুলে ভারতীয় শিল্পকলা অধ্যয়নের জন্য একটা বিশেষ শাখা স্থাপন করে অবনীন্দ্রনাথের উপর তার ভার অর্পণ করা হয়। এখানে নন্দলাল বসু, অসিত হালদার, সুরেন কর, সুরেন গাঙ্গুলী প্রভৃতি বহু শিক্ষার্থী ভারতীয় শিল্পশাখার ছাত্ররূপে সমবেত হন।

অবনীন্দ্রনাথ ভারতীয় শিল্পশাস্ত্র অধ্যয়নের সাথে সাথে মুঘল ও রাজপুত চিত্ররীতির চিত্র দেখে বহু চিত্র নকল করেছিলেন এবং অধীত বিদ্যা নিয়ে স্বতন্দ্বভাবে যে ছবিগুলি একেছিলেন, সেগুলি দেখে তৎকালীন যুগের সাহিত্যিক সুরেশ সমাজপতি প্রমুখ ব্যক্তিরা সাময়িক পত্রিকাগুলিতে, বিশেষভাবে তৎকালীন ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় বিরূপ সমালোচনা প্রকাশ করতে থাকেন । অবনীন্দ্রনাথ নিজ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সর্বদাই নিন্দা প্রশংসার ঊর্ধ্বে থাকার চেষ্টা করতেন। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শিল্পীর অঙ্কিত চিত্রগুলি তার ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন ।

তিনি ‘পথিক ও পথ’ নামক চিত্রখানি অঙ্কন করেন । ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে ‘স্টুডিও’ পত্রিকায় এই চিত্রগুলি প্রকাশিত হয়। ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে ‘মৃত্যুশয্যায় সাজাহান’ চিত্রখানি দিল্লীর দরবারে রৌপ্যপদক লাভ করে।
চিত্রের বিষয়বস্তুর সঙ্গে বর্ণের টোন ব৷ সুরসঙ্গতি চিত্রের বিষয়বস্তুর একটি অন্তরঙ্গ সন্নিবেশ রূপে তাকে ভাব ও রসসমৃদ্ধ করে। জাপানী চিত্ররীতির এই তত্ত্ব অবনীন্দ্রনাথকে একটা নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল ।
জাপানী পদ্ধতিতে চিত্রে ওয়াশ বা বর্ণপ্রলেপের সাহায্যে যে মিস্টিক ভাব বা রহস্য সৃষ্টি হয়, দর্শকের মনে তা কৌতূহল ও আকুলতা এনে দেয়।

অবনীন্দ্র অজন্তাকে শ্রদ্ধা করেছেন, তাকে অনুকরণ করা পছন্দ করেননি। সর্বরকম শিল্পমত ও পথকে তিনি তার নিজস্ব স্রোতের আবর্তে এনে যুক্ত করেছিলেন সত্য, কিন্তু অনুকরণ করার শিক্ষা বা অপরের হুকুম মেনে চলা অবনীন্দ্রের রক্তধারার মধ্যে কোনকালে ছিল না।

দেহগঠনের সময়েও ভারতীয় রীতির ছন্দ ঠিক রেখে পশ্চিমদেশীয় অ্যানাটমি তিনি তাঁর চিত্রের ফিগার গুলিতে প্রয়োগ করেছেন ।শিল্পী চিত্রে আলোছায়া৷ প্রয়োগ করেছেন অপূর্ব কৌশলে, রেখার কঠোরতার সঙ্গে আলোছায়া আত্মীয়তা ও বন্ধুত্ব করেছে । অবনীন্দ্রনাথ তাঁর চিত্রে যে আলোছায়৷ প্রয়োগ করেছেন, তাতে ভারতীয় রীতির প্রাণকণিক৷ আহত হয়নি। তিনি যে আলোছায়া প্রয়োগ করেছেন, তাতে রেখ৷ সঞ্জীবিত ও পুষ্ট হয়েছে।

দেহের তাল-বিভাগের যে নিয়ম ইওরোপীয় শিল্পে বিধিবদ্ধ আছে, তিনি তা গ্রহণ করেননি। তিনি ভারতীয় শিল্পশাস্ট্রের নিয়ম মেনে তার চিত্রের ফিগার-গুলি অঙ্কন করেছেন। ঐগুলিতে শুধু ইওরোপীয় শিল্পবৃদ্ধি নিয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ড্রইং-গুলি নিখুত করার চেষ্টা করেছেন, ভারতীয় শিল্পের মূলতত্ত্ব—ছন্দ– তাতে কিছুমাত্র আহত হয়নি।

অবনীন্দ্রনাথের বহু চিত্র ভারতের বাইরে চলে গিয়েছে, ঐগুলির সংবাদ সংগ্রহ করা এখন আর সম্ভব নয়। অধিকাংশ চিত্রই জলরঙ দিয়ে আঁক] বলে, কাগজের জীবনীশক্তির উপর তাদের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল ছিল। দুঃখের বিষয়, অযত্নে বহু চিত্র বিবর্ণ ও নষ্ট হতে চলেছে, ঐগুলি সংরক্ষণের কোন সুবন্দোবস্ত হয়নি।

১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ‘ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’ প্রতিষ্ঠানে অবনীন্দ্রনাথ যোগদান করে এখানে শিল্প বিদ্যালয় স্থাপন করায় বহু শিক্ষার্থী এসে ভিড় করে।
মৃত্যুর প্রায় কুড়ি বৎসর পূর্বে জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি চিত্ররচনা পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ নূতন রূপজগতে প্রবেশ করেন।

শেষবারের মত তিনি সম্বিৎ ফিরে পান রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে; তখন জীবনের শেষ চিত্র রূপে তিনি আঁকলেন ‘সম্মুখে শান্তির পারাবার’। ঐ দুইখানি চিত্রই তাঁর জীবনের শেষ চিত্র ৷ ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে শিল্পী নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন ৷





Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*