পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে এসে পৌঁছে রেসকোর্স ময়দানে যে বক্তৃতা দেশবাসীর উদ্দেশে দিয়েছিলেন তাতে ফুটে উঠেছে তাঁর অনবদ্য ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বগুণ। স্বাধীন বাংলার মানুষকে ভালবেসে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রয়াস, রাজাকার তথা দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অঙ্গীকার এবং একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জন্য ছিল দিকনির্দেশনা।
প্রথমেই বলেছেন, ‘আমি প্রথমে স্মরণ করি, আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সিপাই, পুলিশ, জনগণকে, হিন্দু-মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে আমি আপনাদের কাছে দু-একটা কথা বলতে চাই। আমার বাংলার মানুষ আজ স্বাধীন হয়েছে…।’ তাঁর বক্তব্যে ঝরে পড়েছে মানুষের জন্য গভীর মমত্ববোধ। একটি স্বাধীন জাতির জনক, কত দীর্ঘ উচ্চারণে সবাইকে একসঙ্গে সম্ভাষণ করে দৃঢ়চিত্তে অথচ গভীর ভালবাসায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রায় যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের কথা উচ্চারণ করেছেন। মুজিববর্ষে দাঁড়িয়ে এ প্রাজ্ঞ নেতা, যিনি সব সময়ে বাঙালীর উন্নয়ন চিন্তা-চেতনায় আচ্ছন্ন ছিলেন, গভীর মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে একদিকে শোকের কথা বলেছেন, অন্যদিকে অর্জিত স্বাধীনতা যাতে নিষ্কলুষ থাকে, সেদিকে তিনি সুদৃঢ়কণ্ঠে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আনন্দ ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন। কাব্যিক ভাষায় তার বিজয় উল্লাসের মাঝেও স্বজন হারানোর বেদনা এবং পাকি ও স্থানীয় দোসরদের দুর্বৃত্তায়ন, যুদ্ধাপরাধের চিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গভীর আত্মবিশ্বাসে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন… ‘কিন্তু, আমি জানতাম আমার বাঙালীকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’… তিনি বাঙালীর প্রতি ভালবাসায় আত্মনিমগ্ন ছিলেন। অবিচল আস্থা রেখেছিলেন। যাতে বাঙালী স্বীয় আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হয়ে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না- এটি উচ্চারণ করেছেন। তাঁর এ উচ্চারণ অন্তরের অন্তস্তল থেকে গভীর বার্তা বহন করে থাকে। এ বার্তায় ঝরে পড়ে হাজার বছরের পরাধীন বাঙালীর ভেতরে বয়ে চলা এক শক্তিমত্তার ধারক ও বাহকের অমিত তেজ- যার সঠিক স্ফূরণ ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সুযোগ্য নেতৃত্বে। আর তাই তো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। অন্যদিকে ওই ভাষণে তিনি বলেন, ‘২য় মহাযুদ্ধেও, ১ম মহাযুদ্ধেও এত মানুষ এত সাধারণ নাগরিক মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই, যা আমার সাত কোটির বাংলাদেশে হয়েছে…।’ এখানে ফুটে ওঠে পাকি ও তার দোসরদের নির্মম পৈশাচিকতা, গণহত্যার বিবরণ। পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রেখে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার প্রয়াস নিয়েও ইয়াহিয়া খান আর তার দোসররা তাঁকে ফাঁসি দিতে সাহস পায়নি। বাঙালীর স্বাধিকার, স্বাধীনতার চিন্তা-চেতনা যাঁর রক্তের শিরা-উপশিরায় প্রবহমান, যিনি বাঙালীকে ভালবেসে নিজ পরিবার-পরিজনকে সময় দিতে পারেননি, যাঁর ধ্যান-জ্ঞান, তপস্যা ছিল বাঙালীর মুক্ত আদর্শ, চিন্তা-চেতনা, সেই ইতিহাসের মহানায়ক বাঙালীদের মধ্যে যে ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছিলেন, তাদের কথা স্মরণ করেছিলেন গভীর শ্রদ্ধায়। এখানেই বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা। আর তাই তো বাঙালীর নয়নের মণি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সদা তৎপর ছিলেন। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল বাঙালীর উন্নয়ন। পাকিস্তানীদের কারাগারে থেকেও অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনায়াসে উচ্চারণ করার সাহস দেখিয়েছিলেন, ‘তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও আমার আপত্তি নেই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালীর কাছে দিয়ে দিও- এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।’ তাঁর এ বক্তব্যে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান….।’ অকুতোভয় এই বীরযোদ্ধা বলদৃপ্তভাবে উচ্চারণ করেছেন মৃত্যুর পর তাঁর লাশটা যেন অন্তত পাকিস্তানীদের হাত থেকে বাঙালীদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এ যেন এক গৃহে থেকেও সন্ন্যাসীর মতো, যোগীর মতো। যাকে প্রতিনিয়ত পাকিরা মৃত্যু ভয়ে ভীত করতে চেয়েছে, পাষাণপুরী অর্থাৎ কারাগারে থেকেও অনায়াসে তিনি সকল মৃত্যু ভীতিকে উপেক্ষা করেছেন। গভীর সন্তোষের সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেন : ‘বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে।’ এ দেশের স্বাধীনতার জনক, যিনি গভীর আত্মপ্রত্যয়ে যে রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন, তিনি অনায়াসে বাংলাদেশ স্বাধীন থাকার কথা ঘোষণা করেছেন। কেউ বাংলাদেশকে দমাতে পারবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি যে বাঙালীকে ভালবেসেছেন। উদারচিত্তে বাঙালীর সকল দুঃখ-বেদনাকে নীলকণ্ঠের মতো বিষ শুষে নিয়ে গভীর প্রত্যয়ে বাঙালীর শৌর্য-বীর্য, উত্থানের চিন্তা-চেতনায় মশগুল ছিলেন। কিসে দেশের মানুষের হিত সাধন হবে, সে উদ্দেশ্যে বলেছেন : ‘আমার রাস্তা নেই, আমার ঘাট নেই, আমার জনগণের খাবার নেই, আমার জনগণ গৃহহারা-সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারী।’ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রকে, ধ্বংসস্তূপ থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি বারংবার রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের জন্য সাহায্য বিভিন্ন দেশের কাছে প্রত্যাশা করেছেন। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের বিপদের দিনে পাশে ছিল, তাদের কথা স্মরণ করেছেন। পাশাপাশি প্রত্যাশা করেছেন ১৯৪৭ থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ঔপনিবেশিক আমলে জর্জরিত অবস্থার কথা। তাই তো তিনি বলেন : ‘আমি হার মানব না, আমরা হার মানতে জানি না।’ এ কথায় তাঁর মধ্যে যে অমিত তেজ, রাষ্ট্রগঠনের পুনর্ভাবনা তা ফুটে উঠেছে। তিনি গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে ওঠেন, যতই সমস্যা হোক, হার মানবেন না- বরং সম্মুখের দিকে এগিয়ে যাবেন। রাজনীতির মহাকবি তাঁর বিজয়মন্ত্রে উচ্চারণ করেন, যে কোন মূল্যে বিজয় ধরে রাখবেন, বাঙালীর উন্নতি বিধানই তাঁর ইচ্ছা।
বাঙালী জাতির পিতা শেখ মুজিব তাই তো বাঙালীর শৌর্য-বীর্য ও স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মদানের আনন্দে বিভোর। তিনি মানুষের অন্তরের কথা উচ্চারণ করেন ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে।’ প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে অন্নের ব্যবস্থার ঘোষণা তিনি দেন। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে গেলে আর্থিক মুক্তির প্রয়োজনীয়তার বার্তা উচ্চারণ করেন। মানুষের মৌলিক উপাদানের অন্যতম অন্নের কথা অবলীলায় বলেন। আর্থিক মুক্তির সঙ্গে অন্নের যে সম্পর্ক, সেটি পেরেটো অপটিমালিটির মাধ্যমে বলা যায়- যাতে কোন মানুষের অবস্থা খারাপ হবে না, বরং ভাল হবে।
তিনি বলেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়’। অরেকটি মৌলিক উপাদানের কথা- যেখানে অন্নের পরেই বস্ত্রের অবস্থান। বস্তুত মানব উন্নয়ন সূচকের অন্যতম আরেকটি প্যারমিটারের কথা বঙ্গবন্ধু স্বাভাবিক নিয়মেই উচ্চারণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর এই সততা ও মানুষের প্রতি ভালবাসা থেকেই তাঁর কর্তব্যজ্ঞান ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ভাবনা এক সূত্রে গাঁথা।
‘এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’ তিনি আবারও আর্থিক মুক্তির জন্য যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের কথা সেদিন বলেই ক্ষান্ত হননি। এমনকি সংবিধান থেকে শুরু করে, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ সর্বত্র কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয় বৈষম্য ও ধন বৈষম্য হ্রাসের সহায়তা করতে প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বগুণ আজও মুক্তির স্বাদ গ্রহণে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। সময়ের ব্যাপ্তিতে আরও যেন শক্ত হয়ে উঠেছে।
‘আমি জানি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই, সাবধান বাঙালীরা, ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই।’ –কি অমোঘ বাণী! বাঙালীকে ভালবাসলেও যে বিশ্বাসঘাতকতা কতিপয় ব্যক্তির জিনে ঢুকে গেছে, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু আগেই তা অনুভুব করেছিলেন। পাকিস্তানী ও তার দোসররা তাদের প্রভুভক্ত কুকুরদের সাহায্যে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু যে অকল্পনীয়ভাবে বাংলাদেশকে উন্নতির তরে পরিচালনা করেছিলেন, নানামুখী ফ্রন্টে রাষ্ট্রের উন্নয়ন শুরু করেছিলেন, তা ছিল অকল্পনীয়। আসলে বাঙালীর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও ভালাবাসাতেই তাঁর জীবনে কালরাত্রি নেমে এলো। মাঝখান থেকে বাঙালী জাতি হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। একুশ বছর সময় লেগেছিল সেই ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনে। যুদ্ধাপরাধীরা স্বাধীন বাংলায় বাংলাদেশের পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে মেড ইন পাকিস্তানে ব্যস্ত ছিল। আজও কি সেই বিশ্বাসঘাতকেরা সক্রিয় সে ব্যাপারে একমাত্র গোয়েন্দারা ভাল বলতে পারবেন। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা চাই জননেত্রীর নেতৃত্বে দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। আর কোন প্রাসাদ ষড়যন্ত্র দেখতে চাই না। বঙ্গবন্ধুর যে উদার মন, তা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নামে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি তৈরি করতে গিয়ে কর্মসংস্থান উন্নত দেশে যেভাবে হ্রাস পাচ্ছে, আমাদের দেশে যেন তা না হয়। সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধির জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। সর্বাগ্রে আজ দরকার কর্মসংস্থান। এক্ষেত্রে সহজ-সরল অঙ্ক নেই। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার সময়ে সেদিন মোশতাক একজনের পরেই ছিলেন বলে ইউটিউবে দেখা যায়। আমরা সেই বিশ্বাসঘাতকদের আর দেখতে চাই না। দেখতে চাই না দুর্নীতিগ্রস্তদেরও। বঙ্গবন্ধু অম্লান থাকুন- মানুষের ভালবাসা যুগে যুগে অক্ষুণ্ণ থাকুক তাঁর প্রতি।
Leave a Reply