১. খ্রিষ্টজন্মের পূর্ব থেকে বাংলাদেশ শৌর্য-বীর্য ও সমৃদ্ধির জন্যে বিশ্ববিশ্রুত। প্লিনি, টলেমি, প্লুটার্ক, ডায়োডোরাস প্রমুখ গ্রিক ধ্রুপদী ঐতিহাসিক এবং সাম্প্রতিককালের রুশ ঐতিহাসিকগণ এ তথ্যই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ৩২৭ খ্রিষ্টপূর্ব প্রাচীন বাঙালি বা গঙ্গারিডদের যুদ্ধসম্ভারের পরিচয় পেয়ে আলেকজান্ডার এদেশ জয়ের আশা ত্যাগ করে স্বদেশ অভিমুখে প্রত্যাগমন করেন।
যুদ্ধসম্ভারঃ ‘পদাতিক সৈন্য ২ লক্ষ, অশ্বারোহী সৈন্য ২০ হাজার, রথ ২ হাজার এবং তিন থেকে চার হাজার
হাতি।’ঃভারতবর্ষের ইতিহাস, কো, আস্তোনভা, গ্রি বোনগার্দ লেভিন, গ্রি কতোভস্কি।
সিসিলির ঐতিহাসিক ডায়োডোরাস বলেছেন, ভারতের সকল জাতির মধ্যে গঙ্গারিডরা শ্রেষ্ঠ। এদের চার হাজার বিরাট যুদ্ধহস্তী আছে এবং এই গঙ্গারিডদের বিশাল হস্তীবাহিনীর কথা জানতে পেরেই বিশ্বত্রাস আলেকজান্ডার এদেশ জয়ের আশা ত্যাগ করেন।
২. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময় (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪, মতান্তরে ৩১৭) বাংলাদেশে এক উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা লক্ষিত হয় এবং তা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে সুস্পষ্ট। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে আরও জানা যায়, পু-ক (উত্তরবঙ্গ) ও ত্রিপুরায় (কুমিল্লা) হীরার খনি ছিল। অর্থশাস্ত্রে গৌড়িক স্বর্ণের উল্লেখ আছে। উত্তরবঙ্গে একবার দুর্ভিক্ষ হলে মৌর্য সম্রাটের আদেশে মহামাতা রাজকোষ থেকে অর্থ ও রাজভান্ডার থেকে শস্য দেন।
৩. খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে বাংলার মসলিন গ্রিসে অতি প্রিয় হয়ে ওঠে।
১ম খ্রিষ্টাব্দে রচিত এক অজ্ঞাতনামা গ্রীক নাবিকের ‘Periplus of the Erythrean Sea’ গ্রন্থে গেনজেটিক বা গঙ্গাজলী (এক প্রকার মসলিন) শাড়ির কথা রয়েছে। এই গ্রন্থ থেকে আরো জানা যায়, প্রাচীন ব্যাবিলনের একটি বস্ত্র তালিকায় মসলিনের উল্লেখ আছে।
৪. বাংলার মসলিন রোমান ললনাদেরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত। ১ম খ্রিষ্টপূর্বে রোমান মহাকবি ভার্জিল জর্জিকাস কাব্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছেন, তিনি জন্মভূমি মন্টুয়াতে ফিরে গিয়ে একটি মর্মর মন্দির স্থাপন করবেন এবং মন্দিরের শীর্ষদেশে স্বর্ণ ও গজদন্তে গঙ্গারিড বা প্রাচীন বাঙালিদের বীরত্বের কথা খোদিত করবেন।
৫. দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দে ইতিহাসবেত্তা টলেমি বলেছেন, গঙ্গে বন্দরের নিকট ছিল সোনার খনি। ‘নি¤œবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদী, ঢাকা আর ফরিদপুরের সোনারং, সোনারগাঁও, সুবর্ণবীথি, সোনারপুর প্রভৃতি নামের সঙ্গে
সোনার ইতিহাস সম্ভবত জড়িত। এই সব জনপদের নদীগুলোতে প্রাচীনকালে বোধহয় গুঁড়া গুঁড়া সোনা পাওয়া যেত।’
Ñনীহাররঞ্জন রায়: বাঙালির ইতিহাস।
৬. পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বিশ্ব ইতিহাসে বলেছেন, গুপ্ত আমলে আর্য সভ্যতার চরম সমৃদ্ধি ঘটে এবং ৪র্থ-৬ষ্ঠ শতকে প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গুপ্ত শাসনাধীনে আসে। গুপ্তদের সময় এ দেশে এক উন্নত সভ্যতা, সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা এবং জনসাধারণের মধ্যে অর্থ প্রাচুর্য ও স্বাচ্ছন্দ লক্ষ্য করা যায়।
৭. পাল আমলে (৮ম-১২শ শতক) বাংলাদেশে বৌদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির চরম বিকাশ ঘটে। আট শতকে দক্ষিণ ভারতে শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের ফলে ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম যখন লুপ্ত হতে বসে, সে-সময় বাংলার মাটিতেই বৌদ্ধধর্ম লালিত হয়। নালন্দা, বিক্রমশীল, ওদন্তপুরী, শালবন, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় এইসব বিহারে অসংখ্য বিদ্যার্থী শিক্ষালাভ করেছেন। সুদূর তিব্বত, চীন, কাশ্মীর থেকে জ্ঞানলাভেচ্ছু ভিক্ষু এদেশে এসেছেন, আবার এখান থেকে দীপঙ্কর অতীশ প্রমুখ মহাপ-িত তিব্বতে গিয়ে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়েছেন।
পাল আমলেই (৮ম-১২শ শতকের মধ্যে) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ রচিত হয়। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ তাদের অন্তরের আবেগ, আকুতি ও অনুভূতি অতি সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চালিত করার জন্য কৃত্রিম ভাষা সংস্কৃত নয়, মাতৃভাষা বাংলাকেই অবলম্বন করেছেন। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঘটে শুভযাত্রা।
৮. তুর্কী আমলে বাংলার সুলতান গিয়াস উদদীন আযম শাহ (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রিষ্টাব্দ) আরব দেশে খয়রাতি সাহায্য পাঠিয়েছেন। ‘সুলতান গিয়াস উদদীন আযম শাহ মুসলমানদের পবিত্র তীর্থস্থান মক্কা ও মদীনায় বহু অর্থব্যয়ে মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং দুই শহরের অধিবাসীদের মধ্যে বিলি করার জন্য বহু অর্থ প্রেরণ করেন। সুলতানের প্রদত্ত অর্থের মধ্যে হতে (মক্কার) শরীফ তাঁর পরিবারের প্রচলিত প্রথা অনুসারে এক-তৃতীয়াংশ নিজে রাখেন এবং বাকি অর্থ পবিত্র শহর দুটির বিদ্বান ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিলি করেন।’
Ñডা. আবদুল করিম: বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল)
৯. বাংলার তুর্কি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পৃষ্ঠপোষকতার আদর্শ পূর্বসূরিদের কাছ থেকে গ্রহণ করে এর চরম পরাকাষ্ঠা দেখান। তিনি বাঙালি ললনাকে ঘরে তুলে বাংলা ভাষাকে হেরেমে এবং দরবারের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষণ করে সারা দেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তোলেন। তার এই মহান আদর্শ উত্তরসূরিদের মধ্যেও সঞ্চালিত হতে থাকে। তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আশ্চর্য বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটে। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করতে গিয়ে এ যুগের একজন ঐতিহাসিক বলেছেন, ‘নিজগুণেই তিনি বড়, তাই ব্রহ্মপুত্র থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত সর্বত্র তাঁর স্মৃতি জনসাধারণের মধ্যে আজও বেঁচে আছে।’
Ñসুকময় মুখোপাধ্যায়: বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর: স্বাধীন সুলতানের আমল
১০. সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সুযোগ্য পুত্র নসরৎ শাহের সময় (১৫১৯-৩২ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার সীমানা যুক্ত প্রদেশের আযমগড় জেলা পর্যন্ত প্রসারিত হয়। তিনি ভারতে আগ্রাসনবাদী শক্তি মোগলদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েন। গঙ্গা নদীতে এই যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে বাঙালিদের কামান চালানোর প্রশংসা করে মোগল সম্রাট বাবর ‘বাবরনামা’য় লিখেছেন: ‘বাঙালিদের কামান চালানোর নৈপুণ্যের জন্য বিখ্যাত। আমরা এখন তার পরিচয় পেলাম। তারা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে কামান চালায় না, যথেচ্ছভাবে চালায়।’ এর তাৎপর্য এই যে কামান চালানোতে বাঙালিরা এতই পটু যে তারা যথেচ্ছভাবে কামান চালিয়েও শত্রুদের পরাস্ত করতে পারে।
১১. মোগল সম্রাট হুমায়ুন গৌড় অধিকার করেন (১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)। গৌড়ের সুরম্য প্রাসাদাবলী ও
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে তিনি খুব মুগ্ধ হন এবং এর নাম রাখেন জান্নাতাবাদ। তিনি বাংলাদেশকে অভিহিত করেন জান্নাত-উল-ফেরদৌস নামে।
১২. মোগল আমলে বাংলাদেশের ঐশ্বর্য, জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য ও মেয়েদের মধুর স্বভাবের ফলে গোরাদের মধ্যে একটা প্রবাদ-বাক্যের উদ্ভব হয়; ‘এদেশে প্রবেশের শত শত দ্বার আছে, কিন্তু বেরুবার পথ একটিও নেই।’ তাই ইংরেজ, ফরাসী, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, জার্মান, ডেনÑ এই সব গোরা বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে এবং বাণিজ্যের নাম করে মুনাফা লুটে নেয়।
সতের শতকের ফরাসী পর্যটক বার্নিয়ার বলেন (১৬৬৬): ‘মিসর অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী দেশ বলে আবহমান কাল থেকে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশে দুবার ভ্রমণ করে আমার এই প্রতীতি হয়েছে যে, মিসরের এই সৌভাগ্য বরং বাংলাদেশেই প্রাপ্য।
১৩. মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেব (১৬৫৭-১৭০৭) সুবে বাংলা ব বাংলাদেশের প্রাচুর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন, জান্নাত-উল-বেলওয়াদ অর্থাৎ জাতিসমূহের স্বর্গ। এই জান্নাতের সম্পদ দিয়েই আওরঙ্গজেব বিশ বছর ধরে দক্ষিণাত্যের যুদ্ধ চালিয়েছেন এবং এই জান্নাতের দৌলতেই দিল্লিতে মোগল সম্রাজ্ঞীদের এবং ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের নবাব-বেগমদের বিলাস- ব্যসন সম্ভব হয়েছে।
১৪. পলাশীর প্রান্তরে বাঙালির স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয় (২৩ জুন, ১৭৫৭)। নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রায় লক্ষ সেনা নিয়ে ক্লাইভের স্বল্প সংখ্যক সেনার কাছে পরাজিত হন মীরজাফরের মুনাফেকিতে। অতি ঘৃণ্য মীরজাফরের কুষ্ঠরোগে মৃত্যু হয়। কিন্তু বাংলার ট্রাজেডি এই যে, মীরজাফরেরা বারবার গোর থেকে উঠে আসে।
১৫. পর্যটক আলেকজান্ডার ডাও বলেছেন, ইংরেজ আগমনের পূর্বে বাংলাদেশ ছিল একটি সোনার থালা; ‘ইংরেজরা আসার আগে বাংলা মুল্লুক ছিল এমন একটি বদ্ধ ডোবা, যেখানে রাশি রাশি স্বর্ণ এসে তলিয়ে যায় ‘The History of Hindustan, আর এই স্বর্ণের সন্ধানে প্রাচীনকাল থেকে বিদেশিরা বাংলায় ছুটে এসেছে।
১৬. ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাইভ পার্লামেন্টে সাক্ষ্যদানকালে বলেন, (১৭৬৬):Bengal the Country of inexhaustible riches. capable of Making its masters the richest corporation in the world. অর্থাৎ ঐশ্বর্যমন্ডিত বাংলাদেশ তার শাসককে জগতের সর্বপ্রধান ধনী হিসেবে গৌরবান্বিত করতে সক্ষম।
আর নবাবী আমলে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে তার অভিমত: The city of Muxadabad is an
extensive populous and rich as the city of London with this difference that there are indivduals in the first possessing ininitely greater property than any of the last city. অর্থৎ মুর্শিদাবাদ নগর লন্ডন শহরের মতো বিস্তীর্ণ, অর্থশালী ও জনবহুল, কেবল প্রভেদ এই যে মুর্শিদাবাদে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা লন্ডনের নাগরিকদের চেয়ে বহুগুণ সম্পদশালী।
১৭. ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন (১৮৯৮-১৯০৫) বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: England is fortunate enough to establish dominion over one of the richest regions of the earth.অর্থাৎ বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে পেরে ইংল্যান্ড অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। বাংলার অর্থেই বিলাত সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, বিলাতের শিল্প বিপ্লব সফল হয়েছে আর ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির কারসাজিতে বাংলার বহুকালের শিল্প-বাণিজ্য সব ধ্বংস হয়ে যায়।
১৮. বিশ শতকের সূচনায় ঔপনিবেশিক শক্তির নাগপাশ ছিন্ন করার জন্যে গড়ে ওঠে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। একদল তরুণ দেশের জন্য মরণপণ করে রক্তের হোলি উৎসবে মেতে ওঠে মায়ের স্বাধীনতার জন্য তারা নিজেদের বলি দেবে।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। চট্টগ্রাম শহর ১৮-২০ এপ্রিল সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকে। ব্রিটিশ ভারতে দুই দশকের ইংরেজ শাসনে এ এক অভিনব ঘটনা। কিন্তু ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা জালালাবাদ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং ইংরেজদের সাথে বীরের মতো লড়াই করে পরাজয়বরণ করেন। উল্লেখ্য, জালালাবাদ পাহাড়ে নিহত তরুণ বিপ্লবীদের শেষকৃত্য ব্রিটিশপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সম্পন্ন করেন।
১৯. ব্রিটিশের শোষণ ও শাসন থেকে মুক্তি পেতে পাকিস্তান অর্জিত হয় (১৪ আগস্ট, ১৯৪৭)। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্যবাদ উৎকট হয়ে দেখা দেয়। তাই তারা প্রথমেই মায়ের ভাষা বাংলার কণ্ঠরোধ করতে চায়। ফাল্গুনের এক রক্তপলাশ ঝরা বিকেলে ভাষার জন্য শহীদ হন বাংলা মায়ের দুলালেরা (একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২)। বিশ্বের ইতিহাসে এটি একটি রেকর্ড।
২০. বাংলা ভাষার জন্যে আন্দোলনই বাংলাদেশ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। নব্য ঔপনিবেশিকবাদকে পর্যুদস্ত করতে সর্বস্ব পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা (মার্চ, ১৯৭১)। ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা লাভ করতে লাগে ২৬ বছর। ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে চল্লিশ বছরের ওপর আন্দোলন করে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে ৯ বছর ধরে লড়াই করে আলজেরিয়া পায় স্বাধীনতা। আর কতকাল ধরে ইরেত্রিয়া রক্তাক্ত সংগ্রাম করে আজও ইথিওপিয়া থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারেনি কিন্তু মাত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে (১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১)। বিশ্বের ইতিহাসে এও একটি রেকর্ড। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জন্ম হয়। যিনি সারাজীবন একটি স্বাধীন ভূখ- ও বাঙালি জাতির উন্মেষ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন।
২১. যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ যেখানে এক কোটি লোকের পুনর্বাসনের প্রশ্ন, যেখানে ঘরে ঘরে হাহাকার আর কান্নার রোল (কেউ হত, কেউ বা আহত), যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন, আর্থিক বুনিয়াদ একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত এমন সকল ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন, সে-সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, bottomless basket; অর্থাৎ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।
২২. ৯ মাসে মাতৃজঠর হতে বিদীর্ণ হয়ে শিশু অনেক বেদনায় যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন কোনো পাপ, কোনো পঙ্খিলতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। সে আর্তচিৎকার করে বন্ধ মুষ্টি তুলে এই পৃথিবীতে স্বীয় অধিকার ঘোষণা করে। তেমনি ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্ত পেরিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম, সেই বাংলাদেশ সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি অতিক্রম করে এই বিশ্বে সসম্মানে সগৌরবে বিরাজ করবে।
ফুটনোট: প্রফেসর মোবাশ্বের আলী ভাষা আন্দোলনের সৈনিক। সাহিত্য সমালোচক, গবেষক, অনুবাদক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন।
Leave a Reply