বেশ কিছুদিন আগের কথা। একটি প্রতিষ্ঠান শিশুদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি। কারণ শিশুদের অনেক অনুষ্ঠানে এবং মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই। তবে এবার যে অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, সেটি অন্য যেকোনো অনুষ্ঠান থেকে ভিন্ন। কারণ এই অনুষ্ঠানে আসছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসার ছোট ছোট গৃহকর্মীরা।
ঠিক সময়ে হলে উপস্থিত হয়ে দেখি হলবোঝাই ছোট ছোট শিশু। গৃহকর্মীদের যে এক ধরনের মলিন চেহারা বা পোশাক থাকে আজকে সেটি নেই, সবাই সেজেগুজে এসেছে। বিশেষ করে যারা স্টেজে গান গাইবে বা নাচবে, তারা আলাদাভাবে সেজে এসেছে। আয়োজকরা গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীদের অনুমতি নিয়ে তাদের পুরো দিনের জন্য নিয়ে এসেছিলেন। সারা দিন নানাভাবে কাটিয়ে বিকেলে এখানে এনেছেন। বাচ্চাগুলো প্রথমে নাচ, গানসহ এ রকম নানা ধরনের অনুষ্ঠান করল। তারপর একসময় আমাকে স্টেজে তুলে দেওয়া হলো তাদের উদ্দেশে কিছু বলার জন্য।
বড় মানুষদের অনুষ্ঠানে যখন আমাকে বক্তব্য দিতে হয়, তখন সব সময়ই কী বলব কিংবা কিভাবে বলব সেটা নিয়ে এক ধরনের সমস্যায় পড়ে যাই। ছোট বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে আমার কখনোই সে সমস্যা হয় না। আমি যেকোনো সময় তাদের সঙ্গে যেকোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি। কিন্তু এই প্রথম আমি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে এই বাচ্চাগুলোকে কী বলব ভেবে পেলাম না। স্কুলের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমি লেখাপড়ার কথা বলতে পারি, এই বাচ্চাদের আমি সেটা বলতে পারব না। তাদের কেউই স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। ছোট ছেলে-মেয়েদের আমি মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলাধুলা করার কথা বলতে পারি, এই বাচ্চাদের আমি সেটা বলতে পারব না, তারা বাসার কাজ করে, বাসন ধোয়, ঘর ঝাড়ু দেয়, কখন তারা খেলাধুলা করবে? আমি সুযোগ পেলেই বাচ্চাদের দেশের কথা বলি, তাদের মনে করিয়ে দিই আমাদের দেশটিতে তাদের জন্য কত সুযোগ অপেক্ষা করছে। এই বাচ্চাদের আমি কেমন করে দেশের কথা বলব? দেশ কী সত্যিই তাদের কিছু দিয়েছে? সত্যিই কি কিছু দেবে? ছোট ছেলে-মেয়েদের আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করি। এই ছেলে-মেয়েদের আমি কোন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাব?
আমি মাইক্রোফোন হাতে কিছুক্ষণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারা কী চমৎকার একটি অনুষ্ঠান করেছে এবং দেখে আমি কত মুগ্ধ হয়েছি—এ রকম অবান্তর কিছু বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করে দিয়ে বললাম, আমি তাদের সবার জন্য একটা করে বই উপহার এনেছি, আমি বক্তৃতা না দিয়ে বরং তাদের সেই বইগুলো দিই।
আয়োজকরা আপত্তি করলেন না এবং আমি তখন স্টেজে পা ঝুলিয়ে বসে গেলাম। আনুষ্ঠানিক প্রগ্রামের বারোটা বেজে গেল এবং বাচ্চাগুলো আমাকে ভিড় করে ঘিরে দাঁড়াল। কতজন বাচ্চা আসবে আমি জেনে নিয়েছিলাম এবং সবাইকে যেন একটা বই দেওয়া যায় সেই সংখ্যক বই নিয়ে এসেছিলাম। বাচ্চাদের অনেকের লেখাপড়া জানে না কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না, তারা খুবই আগ্রহ নিয়ে নিজের উপহারটি নিল। এর মাঝে হঠাৎ এক শিশু বইটিতে আমার অটোগ্রাফ নিতে চাইল, তখন তার দেখাদেখি সবাই তাদের বই নিয়ে এলো অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য। আমি বসে বসে অটোগ্রাফ দিতে দিতে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। বেশ অবাক হয়ে লক্ষ করেছি দু-একজন বাসায় কাজ করার পাশাপাশি কাছাকাছি কোনো একটা স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। যার অর্থ বাসায় গৃহকর্মী হলেই তাকে সারা জীবন নির্যাতন সহ্য করে একটি অসহনীয় জীবন কাটাতে হবে এটি সত্যি নয়। গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্ত্রী যদি স্নেহপ্রবণ হন, তাহলে এই শিশুদের একটা সুন্দর জীবন উপহার দেওয়া যায়।
আমার মাঝেমধ্যেই এই ফুটফুটে শিশুদের কথা মনে পড়ে। এই আয়োজকদের আগ্রহে তারা তাদের দৈনন্দিন একঘেয়ে আনন্দহীন জীবনে মাঝখানে একটি দিনকে আলাদাভাবে উপভোগ করেছিল। তারা ছিল খুবই সৌভাগ্যবান গৃহকর্মী, তাদের গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী তাদেরকে তাদের মতো করে একটি দিন কাটাতে দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য নাচ-গানের রিহার্সাল করতে দিয়েছিলেন কিন্তু অন্য গৃহকর্মীরা কেমন থাকে আমরা সাধারণত তাদের খোঁজ পাই না। জান্নাতীর মতো একজন শিশু যখন খবরের কাগজের সংবাদ হয়ে যায়, তখন হঠাৎ করে কয়েক দিনের জন্য আমরা সচকিত হই। তারপর আবার ভুলে যাই। দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে কত কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে এই বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় কোথায়?
২.
সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে শিশু গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এ দেশে জেএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও প্রায় ২০ লাখ। অর্থাৎ এই দেশে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছে এবং জেএসসি পরীক্ষার সুযোগ পেয়েছে—এ রকম প্রত্যেক শিশুর জন্য একজন করে শিশু আছে, যারা স্কুলে যাওয়ার বা লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি। জেএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর সাংবাদিকরা যখন দেশের ভালো ভালো স্কুলে গিয়ে হাত উঁচু করে ‘ভি’ সাইন দেখানো আনন্দমুখর হাস্যোজ্জ্বল ছেলে-মেয়েদের ছবি দেখাবে, তখন আমাদের কল্পনা করে নিতে হবে যে প্রত্যেকটি হাসিমুখের পেছনে একটি করে মলিন মুখের শিশু আছে। যাকে আমরা কিছু দিতে পারিনি, তাদের অভাবি মা-বাবারা এই শিশুকে পেটেভাতে কিংবা অতি সামান্য বেতনে অপরিচিত নির্বান্ধব আনন্দহীন পরিবেশে সপ্তাহে সাত দিন এবং প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে দিয়ে দু-একটি পরিবারের সজ্জন মানুষরা হয়তো এই শিশুগুলোকে আদর করে নিজের সন্তানের মতো দেখেশুনে রাখেন; কিন্তু বেশির ভাগ শিশুর জীবন দুর্বিষহ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য হচ্ছে, প্রতিবছর গড়ে ৫০ জন শিশুগৃহকর্মী নির্যাতনের জন্য মারা যায়। মৃত্যু হচ্ছে নির্যাতনের একেবারে চরম রূপ, একেবারে শেষ পর্যায়, নৃশংসতার সবচেয়ে ভয়াবহ ছবি। কিন্তু সেই শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে আরো অনেক ধাপ আছে। যদি ৫০ জন শিশুকে নির্যাতন করে হত্যাই করে ফেলা হয়, তাহলে কত গৃহকর্মীকে না জানি কতভাবে নির্যাতন করা হয়, যার খবর আমরা কোনো দিন জানতে পারি না। খবরটি শেষ পর্যন্ত যখন খবরের কাগজ পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন চক্ষুলজ্জার খাতিরে কিছু একটা করতে হয়; কিন্তু যদি খবরের কাগজ পর্যন্ত না পৌঁছায় তখন কী হয়?
আমার মনে অনেক দিন থেকে খুব সহজ একটা প্রশ্ন। যদি প্রতিবছর ৫০ জন শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে হত্যা করে ফেলা হয়, তাহলে গড়ে প্রতিবছর ৫০ জন হত্যাকারীকে বিচার করে ফাঁসি দিতে দেখি না কেন? ফাঁসি যদি না-ও হয় অন্তত বিচার করার এবং ঠিক ঠিক শাস্তি দেওয়ার খবরটি আমরা শুনতে পাই না কেন? আমরা শুধু নির্যাতনের খবরটি পাই; কিন্তু নির্যাতনের বিচার করে শাস্তি দেওয়ার খবরটি কেন পাই না? যদি বছরে ৫০ জনের বিচার করা হয়, তাহলে প্রতি মাসে চারটি বিচারের খবর থাকার কথা। প্রতি সপ্তাহে একটি। তাহলে সেই খবরগুলো কোথায়? হত্যা মামলার বিচার কি অনেক গুরুত্ব দিয়ে গণমাধ্যমে আসার কথা নয়?
প্রকৃত কারণটি আমি জানি না। অনুমান করতে পারি, যারা এই অসহায়-অবোধ শিশুদের নির্যাতন করে মেরে ফেলেন, তাঁরা সমাজের ওপরতলার মানুষ, তাঁরা ছলেবলে, কৌশলে মামলার সেই বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসেন। সম্ভবত শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। যেহেতু খবর দেওয়ার মতো কিছুই নেই, তাই আমরা কোনো খবরই পাই না। সাংবাদিকরা একটি একটি করে সব হত্যাকাণ্ডের তালিকা করে কোনটি বিচারের কোন পর্যায়ে আছে, কারা পুরোপুরি ছাড়া পেয়ে বহাল তবিয়তে নিজের সন্তান এবং পরিবার নিয়ে সুখে দিনাতিপাত করছে, সেগুলো আমাদের জানাতে পারে না। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে।
৩.
শিশু জান্নাতীর হত্যাকাণ্ডটি আমাদের সবাইকে খুব কষ্ট দিয়েছে। যে ভদ্র মহিলার নির্যাতনে এই শিশুটি মারা গেছে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্ত্রীকে ফেলে রেখে স্বামী ভদ্রলোক পলাতক। হয়তো ধরা পড়বেন, হয়তো গ্রেপ্তার হবেন, হয়তো কখনো বিচার হবে। হয়তো আইনের নানা ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাবেন—কারোই বিচার হবে না। আমরা কয়েক দিন পরে সব কিছু ভুলে যাব। যখন নতুন আরেকজন জান্নাতী এ রকম নৃশংস অত্যাচারে মারা যাবে, তখন কয়েক দিনের জন্য আমরা সচকিত হব। আবার খবরের কাগজে লেখালেখি হবে।
আমার মাঝেমধ্যেই মনে হয়, এই দেশে তার চেয়ে বেশি কিছু কি করা যায় না? মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কিংবা গৃহকর্মীদের সুরক্ষার সংগঠনগুলো নিশ্চয়ই ভেবে ভেবে বের করেছে, ঠিক কিভাবে এই গৃহকর্মীদের রক্ষা করা যায়। কিভাবে তাদের আনন্দময় জীবন উপহার দেওয়া যায়। সেটি সত্যি সত্যি বাস্তবে রূপ দেওয়া কতটুকু কঠিন?
আমি ইদানীং অনেক কিছু নিয়ে খুব আশাবাদী। যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা প্রায় হাল ছেড়ে দিই, হঠাৎ করে দেখি সেটি হয়ে গেছে। আমি, বিশেষ করে আমাদের হাইকোর্টের ভূমিকা দেখে খুবই মুগ্ধ। এ দেশের রুগ্ণ নদীগুলো যেন আমাদের মতো জীবন্ত মানুষ, তাই তাদের প্রায় মানুষের মর্যাদা দিয়ে দেওয়া আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। আমি, বিশেষ করে মুগ্ধ হয়েছি মেয়েদের জন্য আলাদাভাবে কিছু নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়গুলোতে। যেমন—বিয়ের সময় শুধু মেয়েদের তাদের কৌমার্য বিষয়ে তথ্য দেওয়ার বিধান ছিল। এখন সেই বৈষম্যটি দূর করা হয়েছে। শ্রমজীবী মায়েদের সন্তানদের জন্য তাঁদের কাজের জায়গায় ডে কেয়ার তৈরি করার অসাধারণ একটি মানবিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কর্মক্ষেত্রে মায়েরা যেন তাঁদের সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন, তার আলাদা জায়গা করে দেওয়ার একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আমাদের দেশের গৃহকর্মীদের প্রায় সবাই মেয়ে। আমি স্বপ্ন দেখি, তাদের আলাদাভাবে সুরক্ষা করার জন্য হঠাৎ করে হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশনা চলে আসবে। একজন শিশুকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে না পারলে তাকে গৃহকর্মী হিসেবে নেওয়া যাবে না—এটি কি খুব বেশি চাওয়া?
জান্নাতীর মুখের মিষ্টি হাসিটির কথা ভোলা কঠিন। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে? কেন আমরা হাসিটি রক্ষা করতে পারলাম না?
Leave a Reply