বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ

মো. ইকবাল হোসেন, বশেমুরবিপ্রবি: ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারে বাংলা ভাষার স্থান ৪র্থ ও বিশ্বে ৬ষ্ঠ এবং বিশ্বব্যাপী মোট ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যানুসারে বাংলা ভাষা ৭ম বৃহত্তম ভাষা। বিশ্বের ২৬০ মিলিয়ন বা ২৬ কোটিরও বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে।

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ যোগাযোগের সহায়ক হিসেবে নানা মাধ্যম ব্যবহার করে আসছে। তন্মধ্যে ভাষা মন ও মননের ভাব প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখযোগ্য মাধ্যম।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “মনুষ্য জাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনিসকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তারই নাম ভাষা।”

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, ” মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে।”

মুহাম্মদ আব্দুল হাই এর মতে, “এক এক সমাজে সকল মানুষের অর্থবোধক ধ্বনির সমষ্টিই ভাষা।”

ভাষা গবেষক সুকুমার সেন এর মতে, ” মানুষের উচ্চারিত অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনি সমষ্টিই ভাষা।”

ড. মুনীর চৌধুরী বলেন, “ভাষা মানুষে মানুষে সম্পর্ক স্থাপনের প্রধানতম সেতু, সামাজিক ক্রিয়া-কর্ম নির্বাহের অপরিহার্য মাধ্যম, সভ্যতার সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ভাষা সাহিত্যের বাহন, ভাবের আধার, আবেগের মুক্তিপথ, চিন্তার হাতিয়ার।”

বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী স্টার্টেভান্ট বলেন, “A language is a system of arbitrary vocal symbols by which members of a social group co-operate andinteract.”

ভাষা হলো বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনি ও ধ্বনিসমষ্টি, যার মাধ্যমে ব্যক্তি আবেগ, অনুভূতি অর্থাৎ মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে অপরের কাছে প্রকাশ করতে পারে।

বাংলা ভাষা ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ইন্দো-ইউরোপীয় (Indo-European) এই ভাষা পরিবারের এমন নামকরণের কারণ হচ্ছে এই পরিবারের ভাষাগুলোর সীমা একদিকে ভারত অন্যদিকে ইউরোপ। বাংলা ভাষা ইন্দো-ইরানীয় ভাষার শাখা থেকে উৎপত্তি।

ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগুলো সাধারণত ১০টি শাখায় বিভক্ত: ক. ইন্দো-ইরানীয় খ. আর্মেনীয় গ. গ্রীক ঘ. আলবানীয় ঙ. ইটালীয় চ. সেলটিক ছ. জার্মানীয় জ. বাল্টো-শ্লাভীয় ঝ. আনাতোলীয়। এবং ঞ. তুখারীয়।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর একটি দল প্রথমে ইরান ও পরে ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে ইউরোপ থেকে এই ভাষা দুটো অঞ্চলে প্রসারিত হয়। এই শাখার মধ্যে ইরানীয় ভাষায় প্রাচীন ভাষার গঠন সংরক্ষিত থাকায় এবং পরবর্তীকালে সংস্কৃত ভাষার প্রাচীন কাঠামো ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা পুনর্গঠনে বিশেষ সহায়তা করে।

ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচীন নমুনা ঋগ্বেদে সংরক্ষিত। ঋগ্বেদের রচনাকাল ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। আর্যগণ ভারতে আসতে শুরু করে আনুমানিক ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। এই তিনশ’ বছরে তারা ভারতে অবস্থান করে যে ভাষা ব্যবহার করত তাকে সুকুমার সেন বলেন, প্রত্ন-ভারতীয় আর্য ভাষা বা প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা। এই ভারতীয় আর্য ভাষা থেকেই আধুনিক ভারতের বাংলাসহ বহু আঞ্চলিক ভাষার উদ্ভব হয়েছে। বাংলাকে তাই ভারতীয় আর্য ভাষার এক সুদূর বংশধর বলা যায়।

আজ পর্যন্ত ভারতীয় আর্য ভাষার জীবনকাল প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর। এই সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাস তিনটি পর্বে বিভক্ত: ক. প্রাচীন ভারতীয় আর্য ( ১৫০০-৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) খ. মধ্য ভারতীয় আর্য (৬০০-১০০০ খ্রিষ্টাব্দ) গ. নব্য ভারতীয় আর্য (১০০০খ্রিষ্টাব্দ-বর্তমান)।

প্রাচীন ভারতীয় ভাষাকে সাধারণত সংস্কৃত ভাষা বলা হয়। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার দুটি পর্যায় বা পর্ব: ক. বৈদিক ভাষা ও সাহিত্য খ. সংস্কৃত। সংস্কৃত ভাষা চারশ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রচলিত ছিল। ঋগ্বেদের প্রাচীনতম শ্লোক এক হাজার খ্রিষ্টপূর্বে রচিত বলে অনুমান করা হয়। পরবর্তীকালে ঋগ্বেদের শ্লোকের ব্যাখ্যা এবং ভাষার সংরক্ষণশীলতার জন্য ঋগ্বেদের ভাষা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা থেকে সংস্কৃতের জন্ম হয়। সংস্কৃত ভাষা চারশ’ খ্রিষ্টপূর্বে প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ভারতে ব্যবহৃত শুদ্ধরূপ সংস্কৃতের পাশাপাশি কথ্যভাষা প্রাকৃত প্রচলিত ছিল। তৎকালীন প্রচলিত ভারতীয় ভাষাকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়: ক. বৈদিক সংস্কৃত (১২০০-৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) খ. ধ্রপদী সংস্কৃত (প্রচলিত রূপ ৪০০ খ্রিষ্টপূর্ব শতকে) এবং গ. প্রাকৃত। বৈদিক ও ধ্রুপদী সংস্কৃতকে প্রাচীন ভারতীয় এবং প্রাকৃতকে মধ্য ভারতীয় স্তরে ফেলা যায় (৬০০-১০০০ খ্রিষ্টাব্দ)।

মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাকে সাধারণত প্রাকৃত ভাষা বলা হয়। যদিও প্রাকৃত বলতে কেবল একটি নির্দিষ্ট ভাষারূপকেই বোঝায় না। আনুমানিক ষষ্ঠ শতকই প্রাকৃতের উদ্ভব বলে মনে করা হয়। প্রাকৃত ভাষার দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে তিনটি পর্ব বা পর্যায়ের কথা বলা হয়। ক. আদি পর্ব- পালি খ. মধ্য পর্ব-প্রাকৃত গ. অন্ত পর্ব-অপভ্রংশ।

মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রথম স্তরের একটি ভাষারূপ হল পালি। পালি শব্দটি সিংহলি বৌদ্ধ পণ্ডিত বুদ্ধদেব ঘোষ যে ভাষায় তাঁর বাণী সাধারণত মানুষের মধ্যে প্রচার করেছিলেন, সেই ভাষাকে পালির প্রাথমিক রূপ বলা যেতে পারে। পালি ভাষা হল সংস্কৃত ও প্রাকৃতের মাঝামাঝি স্তর। পালি ভাষার ব্যাকরণ সংস্কৃতের চেয়ে অনেক সহজ। পালিকে অনেক ভাষাতাত্ত্বিকগণ প্রাকৃতেরই প্রাথমিক রূপ বলে মনে করেন।

প্রাকৃত ভাষা কতকগুলো শাখায় বিভক্ত ছিল। যথা: মাহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, অর্ধমাগধী, মাগধী ও পৈশাচী। মগধ অঞ্চলের প্রাকৃতকে মাগধী বলা হতো। মাগধীর মধ্যে কিছুটা কৃত্রিমতা ছিল। অশ্বাঘোষের নাটকে মাগধীর ব্যবহার দেখা যায়। অর্ধমাগধী ব্যবহার করত মূলত জৈনরা। একে জৈনপ্রাকৃতও বলা হয়। প্রাকৃতের শেষ পর্বের দুটি স্তরকে পৃথকভাবে দেখব- একটি অপভ্রংশ এবং অপর স্তরটি অবহট্ঠ বা অপভ্রংশ।

একথা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে, বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে। কিন্তু অপভ্রংশেরও আঞ্চলিক বিভিন্নতা ছিল। সরাসরি প্রাকৃতের মধ্য স্তর থেকে যে বাংলার উদ্ভব হয়নি একথা সকলেই মানেন। স্যার জর্জ গিয়ারসন বলেছেন বাংলা এসেছে মাগধী অপভ্রংশ থেকে। এই মতটি সাধারণভাবে প্রচলিত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, বাংলার উদ্ভব হয়েছে গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকে। আর এক দল বলেন, বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা, অন্যভাবে সংস্কৃতই বাংলা ভাষার জননী।

মাগধী প্রাকৃতের পরের ভাষারূপ হল মাগধী অপভ্রংশ বা অবহট্ঠ এবং এ থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। এ কথা গিয়ারসন, সুনীতিকুমার ও সুকুমার সেনও বলেছেন। অনুমান করাই যায় এই রকম একটি বিবর্তন-সূত্র: মাগধী প্রাকৃত > মাগধী অপভ্রংশ ও অপভ্রষ্ট > মৈথিলি, ওড়িয়া, অসমিয়া, বাংলা। সেক্ষেত্রে বলাই যায়, সুনীতিকুমার, সুকুমার সেন ও দ্বিজেন্দ্রনাথ বসুর অনুসরণে যে, মাগধী অপভ্রংশই বাংলা ভাষার জননী।

ইংরেজ শাসনের প্রায় ১৯০ বছর পরে ‘৪৭ এর দেশ বিভাগ, মাতৃভাষা বাংলা অধিকার রক্ষায় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রজনতার প্রাণ উৎসর্গ ও ত্যাগ, ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুথ্থান ও ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের রক্তক্ষয়ী বহু সংগ্রামের পর ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা প্রদান করেছে। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিশ্বের ১৯৩টি দেশে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ-৮১০০।





Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*