যেভাবে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়েছিল

 বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান নবাব সিরাউদ্দৌল্লা

যেভাবে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়েছিল

মো. ইকবাল হোসেন, বশেমুরবিপ্রবি: বঙ্গীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে পলাশীর নামক প্রান্তরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইংরেজদের কাছে আঠারো শতকের বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। ইংরেজরা ক্ষমতা কাঠামো দখল করে ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯০ বছর ভারতীয় উপমহাদেশ তথা পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ সুপরিকল্পিতভাবে শাসন ও শোষণ করে। এদেশের সঙ্গে ইংরেজ বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, সমকালীন ইউরোপে ভৌগোলিক আবিষ্কার ও বাণিজ্যিক বিপ্লবের ওপর ভিত্তি করে যে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং উপনিবেশে বিস্তারে উম্মাদনা তৈরি হয়েছিল তারই পরিণতি পলাশী।

স্বর্ণ, হীরা-মানিক, দারুচিনি, এলাচ ইত্যাদি ভোগ্যপণ্য প্রাচ্য দেশ থেকে ইউরোপ যেত এবং বাংলা থেকে যেত জগদ্বিখ্যাত মসলিন। অর্থাৎ কল্পনা রঙিন, ঐশ্বর্যবান বাংলার একটি চিত্র বিদেশিদের মনে মুদ্রিত হয়েছিল। ১৪৫৩ খ্রি. তুর্কি শাসকরা কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) দখল করার পর থেকে তারা ভূমধ্যসাগর এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তখন প্রতীচ্যের দেশগুলো একটি বিকল্প বাণিজ্য পথের সন্ধান করেছিল। আর এই মরিয়া প্রচেষ্টা থেকে পনের শতকে শুরু হয় ভৌগোলিক আবিষ্কার এবং নৌপথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ভারতে আসার প্রথম প্রচেষ্টা চালায় পর্তুগাল ও স্পেনের নাবিকরা। কলম্বাস ভারতে আসার জন্যে যাত্রা করেছিলেন কিন্তু তিনি গিয়ে পৌঁছেন আমেরিকা মহাদেশে। ১৪৯৮ সালে ভাস্কো-দা-গামা ভারতের কালিকট বন্দরে পৌঁছেন। এভাবে ইউরোপীয়দের সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

ইংরেজদের আগমন:

বাংলা তথা ভারতবর্ষের সাথে প্রথম পরিচয়ে ইউরোপীয় বণিক, সৈনিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক এবং রাজদূতগণ বিস্ময়ে মুগ্ধ এবং হতবাক হয়েছিলেন। প্রাচীনকালে স্ট্রাবো, হেরোডটাস এবং মেগাস্থিনিসের বিবরণী থেকে জানা যায় যে, এই অঞ্চলটি বিত্তবৈভব এবং অতুল ঐশ্বর্যের পীঠস্থান ছিল।
ইংরেজরা হচ্ছে বণিকের জাত। ১৫৯৯ খ্রি. ইংরেজ বণিকরা প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করার জন্যে গঠন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৬০০ খ্রি. রাণী এলিজাবেথ এই কোম্পানিকে রাজকীয় সনদ বা চার্টার ১৫ বছর মেয়াদী একচেটিয়া বাণিজ্য করার জন্য প্রদান করেন এবং তিনি স্বয়ং এই কোম্পানির একজন অংশীদার ছিলেন। রাজকীয় অনুগ্রহের আশায় ক্যাপ্টেন হকিন্স নামে এক ব্যক্তিকে ১৬০৮ সালে রাজা প্রথম জেমসের সুপারিশপত্র নিয়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আগ্রায় মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে পাঠানো হয়। সম্রাটের অনুমতি নিয়ে ১৬১২ সালে সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়। ১৬১৫ সালে প্রথম জেমসের দূত হয়ে জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন স্যার টমাস রো। সম্রাটের কাছ থেকে ইংরেজদের ভারতবর্ষে বাণিজ্য করার সুবিধা আদায় করে ১৬১৯ সালে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন। ইতোমধ্যে কোম্পানি সুরাট, আগ্রা, আহমেদাবাদ প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে ভিত্তি মজবুত করে।
১৬৬৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগিজ রাজকণ্যা ক্যাথারিনের সাথে বিয়ের যৌতুক হিসেবে লাভ করেন বোম্বাই শহর। অর্থাভাবে চার্লস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পঞ্চাশ হাজার পাইন্ডের বিনিময়ে শহরটি বিক্রি করে দেন এবং এই শহরটি কোম্পানির প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। জব চার্নক নামে আরেক ইংরেজ ১৬৯০ সালে ১২০০ টাকার বিনিময়ে কোলকাতা, সতানটি ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামের জামিদারিস্বত্ব লাভ করেন। ভাগীরথী নদীর তীরের এই তিনটি গ্রামকে কেন্দ্র করেই পরে কোলকাতা নগরীর জন্ম হয়। ১৭০০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের নামানুসারে এখানে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ নির্মাণ করা হয়। ধীরে ধীরে এটি ইংরেজদের বাণিজ্য ও রাজনৈতিক স্বার্থ বিস্তারের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ইংরেজ কোম্পানির ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায় যখন দিল্লির সম্রাট ফাররুখশিয়ার তাদের বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার প্রদান করেন। একই সাথে কোম্পানি নিজস্ব মুদ্রা প্রচলনের অধিকারও পায়। সম্রাটের এই ফরমানকে ইংরেজ ঐতিহাসিক ওরমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মহা সনদ বা ম্যাগনা কার্টা বলা হয়। এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অপ্রতিরোধ্য গতিতে অগ্রসর হতে থাকে।

ইংরেজদের অন্যান্য বাণিজ্য কাঠামো দখল:

১৪৯৮ সালের ২৭শে মে ভারতের পশ্চিম-উপকূলের কালিকট বন্দরে আগমনের মধ্য দিয়ে পর্তুগীজদের ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য বিস্তারের পথ সুগম হয়। কিন্তু পরবর্তীতে পর্তুগীজদের অপকর্ম ও দস্যুতার কারণে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান তাদের চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপ থেকে বিতাড়িত করে এবং ইংরেজরা এদেশ ত্যাগ করে চলে যায়।
১৬০২ সালে হল্যান্ডের অধিবাসী ওলন্দাজ বা ডাচরা “ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” গঠন করে এদেশে আসে। তারা কালিকট, নাগাপট্টম, বাংলার চুঁচুড়া ও বাঁকুড়া, বালাসোর, কাশিমবাজার এবং বরানগরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বিরোধ শুরু হওয়ায় ১৭৫৯ সালে বিদারার যুদ্ধে ডাচরা ইংরেজদের কাছে শোচনীয়ভাবে হয়। পরে ১৮০৫ সালে বাণিজ্য কেন্দ্র গুটিয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং ইংরেজ শক্তির উন্থানের পথ সুগম হয়।
দিনেমার বা ডেনমার্কের অধিবাসী একদল বণিক বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে “ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া” কোম্পানি গঠন করে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে। কোম্পানি ১৬২০ সালে দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোর জেলায় ত্রিবাঙ্কুর এবং ১৬৭৬ সালে বাংলার শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ব্যবসায় লাভজনক না হওয়ায় তারা ১৮৪৫ সালে ইংরেজদের কাছে বাণিজ্য কুঠি বিক্রি করে এদেশ ছেড়ে চলে যায়।

উপমহাদেশে সর্বশেষ আগত ইউরোপীয় বণিক কোম্পানি হচ্ছে “ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া” কোম্পানি। ১৬৬৪ সালে কোম্পানি গঠিত হয়। তারা সুরাট, মুসলিমপট্টম, পন্ডিচেরি, চন্দননগর, কাশিমবাজার বালাসোরে ফরাসি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে বাংলা, বিহার উড়িষ্যায় বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। ইংরেজদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যে দ্ব›দ্ব ও পলাশীর যুদ্ধে ফরাসিদের নবাবের পক্ষ অবলম্বন করার কারণে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ফরাসিরা পরাজিত হয়ে প্রায় একশ বছর পর ভারতীয় উপমহাদেশ ত্যাগ করে। ফলে ইংরেজরা ভারতবর্ষে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত হয়।

বাংলার মসনদে সিরাজের আরোহণ:

নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ই এপ্রিল তাঁর দৌহিত্র সিরাজ উদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন। আলিবর্দী খান মৃত্যুর পূর্বেই সিরাজকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়েছিল ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে এবং মুর্শিদাবাদের মসনদে বসার সময় তাঁর বয়স ছিল ২৩ বছর। ইতোপূর্বে মাতামহের সান্নিধ্যে থেকে তিনি সমরনীতি ও শাসন বিষয়ে দীক্ষা লাভ করেন। আলিবর্দী খান তাঁকে বিহারের নায়েব নাযিম নিযুক্ত করেন। তিনি মাতামহের সঙ্গে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অংশ নেন।
সিরাজের প্রতি বিরূপ থাকায় তাঁর খালা ঘসেটি বেগম সিরাজের এক খালাতো ভাই শওকত জঙ্গকে মসনদে বসানোর জন্য ষড়যন্ত্র করেন। তিনি তাঁর বিপুল সম্পদ ও প্রতিপত্তি নতুন নবাবের বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। অন্যদিকে নবাবের প্রধান সেনাপতি ও বখশী মীর জাফরের ভ‚মিকাও ছিল কুচক্রীর। এদের প্ররোচনা ও সমর্থনে উৎসাহিত হয়ে পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গ সিরাজের প্রতি অবাধ্য হন এবং তাঁর আনুগত্য মেনে নিতে অস্বীকার করেন। মসনদে আরোহণের পর সিরাজ উদ্দৌলা যথেষ্ট সাহস ও দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় দেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, ঘরের শত্রুকে দমন করতে না পারলে তাঁর মসনদ নিষ্কণ্টক হবে না। তিনি প্রথমে প্রশাসনে কতিপয় রদবদল করেন। মীর জাফরকে বখশীর পদ থেকে অপসারণ করে মীর মদনকে ঐ পদে নিযুক্ত করেন। তাঁর পারিবারিক দেওয়ান মোহনলালকে সচিব পদে উন্নীত করেন এবং তাঁকে মহারাজা উপাধিসহ প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়। মোহনলালের পিতৃব্য জানকিরামকে ‘রায় রায়ান’ উপাধিসহ নিজের দেওয়ান নিযুক্ত করেন। এরপর নবাব শত্রুদের বিরুদ্ধে আঘাত হানেন। প্রথমে তিনি ঘসেটি বেগমের মতিঝিল প্রাসাদ অবরোধ করে ধনরত্নসহ তাঁকে নবাবের মনসুরগঞ্জ প্রাসাদে নিয়ে আসেন। এরপর নবাব শওকত জঙ্গকে দমনের উদ্দেশ্যে পূর্ণিয়া অভিমুখে যাত্রা করেন। তিনি সৈন্যবাহিনীসহ রাজমহল পৌঁছলে শওকত জঙ্গ ভয় পেয়ে ১৭৫৬ সালের ২২শে মে নবাবের প্রতি আনুগত্য দেখান। এতে সিরাজ তাঁর সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করে নেন।

ইংরেজদের সঙ্গে বিবাদ:

নবাব সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসার অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধ সৃষ্টি হয়।
প্রথমত, সিরাজ যখন মসনদে বসেন তখন প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকগণ উপঢৌকনসহ তাঁকে অভিনন্দন জানায়, কিন্তু ইংরেজ বণিকরা তা করেনি।এ স্বীকৃত রীতি উপেক্ষা করায় নবাবের প্রতি অসম্মান করা হয়।
দ্বিতীয়ত, কোম্পানির কর্মচারীরা বেআইনীভাবে ব্যক্তিগত ব্যবসায় লিপ্ত হয় এবং ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাটের দেয়া ফরমানের সুবিধার অপব্যবহার করে। কোম্পানির গভর্নর দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের জন্য তাদেরকে দস্তক দিতেন। এভাবে শুল্ক ফাঁকি দেয়ায় মুঘল রাজকোষের অসামান্য ক্ষতি হয়। সিরাজ উদ্দৌলা দস্তকের অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দিলেও ইংরেজ গভর্নর ড্রেক সে নির্দেশ উপেক্ষা করেন।
তৃতীয়ত, ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধার উপক্রম হয়। এর প্রভাব ভারতে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকদের ওপর এসে পড়ে। ইংরেজরা এ পরিস্থিতিতে কলিকাতায় এবং ফরাসিরা চন্দননগরে সমরসজ্জা ও দুর্গ নির্মাণ করতে শুরু করে। সিরাজউদ্দৌলা ইউরোপীয় বণিকদের এদেশে দুর্গ নির্মাণের কাজ বন্ধ করার আদেশ দেন। ফরাসিরা তাঁর আদেশ মেনে নেয়, কিন্তু কলিকাতার ইংরেজ গভর্নর ড্রেক নবাবের নির্দেশ অমান্য করে দুর্গ নির্মাণ কাজ চালাতে থাকে।
চতুর্থত, কলিকাতার ইংরেজ কর্তৃপক্ষ নবাবের অবাধ্য ও অপরাধী কর্মচারীদেরকে আশ্রয় দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে উষ্কানীমূলক কাজে লিপ্ত হয়। রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস ও তার পরিবারের সদস্যদেরসহ প্রচুর ধন-সম্পদ নিয়ে কোলকাতায় ইংরেজদের কাছে আশ্রয় নেন। তাকে ফেরত দেয়ার জন্য নবাব ইংরেজদের নিকট দূত পাঠান। ইংরেজ গভর্নর নবাবের দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। এর আগে শওকত জঙ্গের বিদ্রোহের সময়ও ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়।
ইংরেজদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ১৭৫৬ সালের জুন মাসের শুরুতে নবাব কোলকাতা দখন করে নেন। যাত্রাপথে তিনি কাশিমবাজার কুঠিও দখন করেন। নবারের অতর্কিত আক্রমণে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। হলওয়েলসহ বেশ কিছু ইংরেজ আত্মসমপর্ণ করতে বাধ্য হয়। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে নবাবকে হেয় করার জন্য হলওয়েল এক মিথ্যা প্রচারণা চালায় যা ইতিহাসে “অন্ধকূপ হত্যা” নামে পরিচিত। এতে বলা হয় যে, ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪.১০ ফুট প্রস্থ ছোট একটি ঘরে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করে রাখা হয়। এতে প্রচন্ড গরমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়। এই মিথ্যা প্রচার মাদ্রাজ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে উত্তেজিত হয়ে কোলকাতা দখল করার জন্য ওয়াটসন ও ক্লাইভ মাদ্রাজ থেকে কোলকাতায় চলে আসে। তারা নবাবের সেনাপতি মানিকচাঁদকে পরাজিত করে কোলকাতা দখল করে নেয়। নবাব তাঁর চারদিকে ষড়যন্ত্র ও শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে ইংরেজদের সাথে নতজানু ও অপমানজনক সন্ধি করতে বাধ্য হন। এটি ইতিহাসে “আলীনগর সন্ধি” নামে খ্যাত।
আলীনগর সন্ধিতে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পর ক্লাইভের উচ্চাকাক্সক্ষা আরো বৃদ্ধি পায়। নবাবের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইউরোপে সংঘটিত সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজরা ফরাসিদের চন্দনগর কুঠি দখল করে নেয়। নবাব এ অবস্থায় ফরাসিদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে ইংরেজদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নেন। এতে ক্লাইভ ক্ষুদ্ধ হয়ে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

পলাশীর যুদ্ধের ঘটনা:

মীর জাফরকে মসনদে বসাবার উদ্দেশ্যে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ক্লাইভের সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসায়ী ধনকুবের জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, রাজা রাজবল্লভ, প্রধান সেনাপতি মীর জাফর প্রমুখ। ক্লাইভ উক্ত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার জন্য উমিচাঁদকে দালাল নিযুক্ত করেন এবং তাকে ২০ লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ এপ্রিল কলিকাতা কাউন্সিল নবাব সিরাজ উদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার পক্ষে প্রস্তাব পাশ করে। মীর জাফরের সঙ্গেও ইংরেজদের একটি খসড়া চুক্তি অনুমোদিত হয়। ষড়যন্ত্রের উদ্যোগ-পর্ব শেষ হলে ক্লাইভ নবাবের বিরুদ্ধে সন্ধি ভঙ্গের মিথ্যা অভিযোগ এনে ইংরেজ সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা করেন। নবাবের হুগলী ও কাটোয়ার ফৌজদাররা তাঁকে বাধা দেয়নি। ইতোমধ্যে নবাব সিরাজ উদ্দৌলা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও গোপন চুক্তির কথা অবহিত হন। নবাব এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং মুর্শিদাবাদ থেকে ২৩ মাইল দক্ষিণে পলাশী প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন ক্লাইভের সৈন্যবাহিনী ও নবাবের মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মীর জাফর, রায় দুর্লভ ও খাদিম হোসেন তাদের সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধে নিস্ক্রিয় ভ‚মিকা পালন করে। নবাবের পক্ষে মোহন লাল, মীর মদন ও সিন ফ্রে মরণপন লড়াই করেও সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বিজয়ী হতে পারেননি। যুদ্ধে মীর মদন নিহত হন। নবাবের বিজয় আসন্ন জেনে মীর জাফর ষড়যন্ত্রমূলকভাবে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। মীর মদনের মৃত্যু ও মীর জাফরের অসহযোগিতা নবাবকে বিচলিত করে। নবাবের সেনাপতি মীর জাফর যুদ্ধক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা করে নীরব র্দশকের ভূমিকায় ছিল। নবাব কোরআন স্পর্শ করিয়ে শপথ নেয়ালেও মীর জাফরের ষড়যন্ত্র থামেনি। নবাবের সৈন্যরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছে, সেই সময় মীর জাফরের ইঙ্গিতে ইংরেজ সৈন্যরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যার অনিবার্য পরিণতি নবারের পরাজয়।

সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু:

শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের নামে যে প্রহসন ঘটে তাতে নবাবের বিশ্বস্ত বাহিনী আত্মসমর্পণ ও পলায়ন করে। নবাব পলাশী থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদ প্রত্যাবর্তন করেন এবং পাটনায় পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি ধরা পড়েন এবং তাঁকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মীর জাফরের পুত্র মিরণের নির্দেশে মুহম্মদী বেগ ১৭৫৭ সালের ২২ই জুলাই তাঁকে হত্যা করে।

সিরাজউদ্দৌলার পতনের কারণ:

১। নবাবের সেনাপতি মীর জাফর ও তার সহযোগীদের যুদ্ধক্ষেত্রে অসহযোগিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা।
২। নবাবের সেনাপতি থেকে সভাসদ অধিকাংশই দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে, ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখেছে।
৩। তরুণ নবাবের অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তার অভাব ছিল। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
৪। সেনাপতি মীর জাফরের ষড়যন্ত্রের কথা জানা সেত্ত্বেও তিনি বার বার তার ওপরই নির্ভর করেছেন।
৫। নবাবের শত্রুপক্ষ ছিল ঐক্যবদ্ধ ও রণকৌশলে উন্নত।
৬। রবার্ট ক্লাইভ ছিল দূরদর্শী, সূক্ষ্ন ও কূটবুদ্ধিসম্পন্ন।

পলাশী যুদ্ধের ফলাফল:

১। সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও মৃত্যু বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটায় ও ঔপনিবেশিক শাসনের পথ সুগম করে।
২। যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা মীর জাফরকে বাংলার সিংহাসনে বসালেও তিনি ছিলেন নামেমাত্র নবাব, প্রকৃত ক্ষমতা ছিল রবার্ট ক্লাইভের হাতে।
৩। পলাশি যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা বাংলায় একচেটিয়া ব্যবসায়-বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। ফরাসিরা এদেশ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
৪। এ যুদ্ধের পর ইংরজ শক্তির স্বার্থে এদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তন হতে থাকে।
৫। পলাশি যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী পরিণতি ছিল উপমহাদেশে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা। এভাবেই এ যুদ্ধের ফলে বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়।

নবাব সিরাজ উদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজে ক্লাইভের সহযোগিতার বিনিময়ে মীর জাফর ইংরেজদেরকে প্রভুত অর্থ প্রদানে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু মসনদে বসে মীর জাফর ইংরেজ কোম্পানিকে তাঁর চুক্তি অনুযায়ী প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি লাভের আশায় মীর জাফর ওলন্দাজ ও আর্মেনিয়ান বণিকদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইংরেজ কোম্পানির কলিকাতা কাউন্সিল মীর জাফরকে অপসারণ করে তাঁর জামাতা মীর কাশিমকে মসনদে বসায়। মীর কাশিমের ইংরেজদের কাছে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে বক্সারের যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য প্রায় দুইশ বছর অস্তমিত যায়।
পরবর্তীতে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতবর্ষ মুক্তি পেয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান ( বর্তমান বাংলাদেশ ) ও পশ্চিম পাকিস্তান এবং ১৫ই আগস্ট ভারত নামক পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

মো. ইকবাল হোসেন, শিক্ষার্থী, ৪র্থ বর্ষ, বাংলা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।





Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*