দেশে বহু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে ও পরীক্ষার সময়ে যেভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চহারে টাকা-পয়সা আদায় করা হয়ে থাকে, তাকে এক ধরনের দুর্নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে শুধু ছাত্রছাত্রী ভর্তির বেলায় অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয় তাই নয়, বরং আরও নানা উপায়ে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর্থিক কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়ে। এসব দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে: প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো, উন্নয়ন তহবিলের অর্থের অপব্যবহার, স্কুলপর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের টিফিন খাতে আদায়কৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার না করা, পরীক্ষা পরিচালনার নামে বিপুল খরচ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা ইত্যাদি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এসব দুর্নীতি হ্রাস করার জন্য সরকারের তরফ থেকে প্রায়ই নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও দুর্নীতিপ্রবণ ব্যক্তিদের প্রতাপের কাছে সেগুলো তেমন কোনো কাজে আসে বলে মনে হয় না। কারণ দেখা যায়, স্কুল থেকে আরম্ভ করে সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও আর্থিক অনিয়মের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকে প্রায়ই। এসব অনিয়মের সঙ্গে এ দেশের কোনো সাধারণ মানুষ জড়িত নন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির সঙ্গে কোনো কৃষক-শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষের জড়িত হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা নেই। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাদের সন্তানরা পড়ালেখা করেন, সেই অভিভাবকদেরও এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হওয়া সম্ভব নয়।
সমাজের যেসব মানুষ স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষালাভ করে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত হন, পরে তাদের অনেকেই সুযোগ বুঝে জড়িয়ে পড়েন দুর্নীতিতে। দুর্নীতিপরায়ণ এসব ব্যক্তির নৈতিক ভিত্তি এতটাই দুর্বল যে তারা অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনকে কোনো খারাপ কিছু মনে করেন না। বরং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করাকে তারা এক ধরনের বিশেষ বুদ্ধি (!) ও কৌশল প্রয়োগে দক্ষতা বলে মনে করেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর্থিক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি ছাড়াও আরও নানা ধরনের দুর্নীতির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে শ্রেণীকক্ষে নির্দিষ্ট রুটিন অনুযায়ী পাঠদান করা। এ ছাড়া পাঠক্রমিক কার্যাবলীর পাশাপাশি সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে শিক্ষার্থীরা সুনাগরিকের গুণাবলী অর্জন করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নকালে ছাত্রছাত্রীরা যাতে সততা, নেতৃত্ব, নিয়মানুবর্তিতা, দেশপ্রেম, সহিষ্ণুতা, শৃংখলা, সময়ানুবর্তিতা ইত্যাদি গুণ অর্জন ও চর্চা করতে পারে, সে অনুযায়ীও তাদের পরিচালনা করা শিক্ষকদের দায়িত্বের অংশ। এসব কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনা না করাও এক ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে ধরনেরআর্থিক দুর্নীতি হয়ে থাকে, সেগুলোর সঙ্গে কতিপয় শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সংশিষ্টতার কথা শোনা যায় প্রায়ই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে যদি বিভিন্ন উপায় বের করে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়, তখন সেখানে কোনো কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হতে পারে না। ফলে বিঘ্ন ঘটে পড়ালেখায়। দেখা দেয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ। প্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি হয় নানামুখী সমস্যার। আর শিক্ষার্থীরা যখন দেখে তাদের শিক্ষকদের অনেকেই পড়ানো বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কাজে বেশি জড়িয়ে পড়ছেন, তখন শিক্ষার্থীদের একটা অংশ অবৈধ উপায়ে অর্থ কামানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির বিস্তার লাভ করে। এ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত করতে না পারলে দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বিস্তারের অন্যতম কারণ হল, সাধারণ অভিভাবকদের নিজ সন্তানদের পড়ালেখা করানোর জন্য এসব প্রতিষ্ঠানে না পাঠিয়ে অন্য কোনো উপায় নেই।
এ দেশে যারা উচ্চবিত্ত এবং যাদের প্রচুর টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ রয়েছে, তাদের অনেকেই সন্তানদের নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে পড়ালেখা করানোর জন্য উন্নত দেশে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের বেলায়। যাদের আয়-রোজগার কম এবং যারা কোনো রকমে কষ্ট করে হলেও নিজের সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে চান, তারাই বাধ্য হয়ে এ দেশের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ গ্রহণ করার চেষ্টা করেন। এ পথে ব্যর্থ হলে তারা অনন্যোপায় হয়ে ঝুঁকে পড়েন উচ্চব্যয়ের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বহু প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে লিপ্ত হয়।
বর্তমানে দেশে জনসংখ্যার তুলনায় সব ধরনের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট অভাব থাকায় ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠছে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যতই দিন যাচ্ছে ততই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। যত্রতত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রবণতা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশে যেন শিক্ষা বিস্তারের স্বর্ণযুগ চলছে। প্রতিটি বড় বড় শহরে গড়ে উঠছে বেসরকারি প্রচেষ্টায় স্কুল-কলেজ। কোথাও কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। অথচ বলতে গেলে কোনো প্রতিষ্ঠানই বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট
করতে পারছে না। বলাবাহুল্য, এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই গড়ে উঠছে স্বল্প পরিসরে ভাড়া বাড়িতে। এমনকি এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে একই ভবনে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থান করে নিয়েছে। সত্য যে, আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় দেশে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব কম, সে কারণে গড়ে উঠছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা দোষের কিছু নয়, যদি সেগুলো সরকারি নিয়ম মেনে স্থাপিত ও পরিচালিত হয় এবং যদি সেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শুধু ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এবং সেগুলো সুযোগ বুঝে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করছে বিপুল পরিমাণ টাকা। কোথাও কোথাও সরকার-নির্ধারিত ফি-এর পরিবর্তে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা নিরুপায় হয়েই প্রতিষ্ঠানের দাবি মতো অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে।
এভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হওয়ার সুযোগ থাকায় শিক্ষার মানের চেয়ে অর্থ উপার্জনই বেশি মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। ফলে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করে।
আমাদের দেশে স্কুলপর্যায়ে যেসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক সরকারের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা পায় না। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের খরচ মেটানোর জন্য শিক্ষার্থীদের দেয়া অর্থের ওপর নির্ভর করে। যেসব খাতে সরকার টাকা আদায়ের জন্য পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয় সেসব খাত ছাড়াও অন্য অনেক অভিনব খাতে প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ আদায় করে প্রায়ই। যেহেতু সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে কোনো আর্থিক সহায়তা দেয় না, সে জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে থাকে একরকম বিনা বাধায়। এভাবে আদায়কৃত অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থেই।
Leave a Reply