মৃত্যুর এই উপত্যকা

আমি দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। মাঝে মাঝেই আমি খবরের কাগজের কোনো কোনো খবর পড়ার সাহস পাই না। হেডলাইনটা দেখে চোখ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। যেন চোখ সরিয়ে নিলেই খবরটা অদৃশ্য হয়ে যাবে। খবর অদৃশ্য হয় না, থেকে যায়। তখন সাহস সঞ্চয় করে একটু একটু করে খবরটা পড়তে হয়। এয়ারপোর্ট রোডে বাস দিয়ে ধাক্কা দিয়ে রাজীব আর মিম নামে দুটি কিশোর-কিশোরীকে মেরে ফেলার খবরটি সেরকম একটি খবর। খবরের কাগজে তাদের ছবি দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠেছে। আমার অনেক বয়স হয়েছে; কিন্তু কেন জানি সবসময় মনে হয় আমার বয়সটা এই বয়সি ছেলেমেয়েদের বয়সের সঙ্গে আটকে আছে। এদেরকে দেখলে মনে হয় আমি এদের বয়সি, এরা কী ভাবে কী কল্পনা করে আমি বুঝি অনুমান করতে পারি। তাই এই দুটি কিশোর-কিশোরীর ছবিটা দেখার পর থেকে খুব মন খারাপ হয়ে আছে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে নানাভাবে মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়, আমরা মেনে নিই। কিন্তু খুনকে মেনে নিতে হয় কে বলেছে? সবাই কি জানে আমাদের দেশে যে ঘটনাগুলোকে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ বলে, সেগুলোর বেশিরভাগ দুর্ঘটনা নয়, সেগুলো পরিষ্কার খুন? ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে একজনকে মেরে ফেলা আর দুটি বাস একটি আরেকটির সঙ্গে কম্পিটিশন করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কতগুলো কিশোর-কিশোরীর ওপর সেই বাসটি তুলে দেওয়ার মাঝে যে কোনো পার্থক্য নেই, সেটি কি সবাই জানে? সবাইকে জানতে হবে। দুর্ঘটনার ওপর কারও হাত নেই, আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুর্ঘটনাকে মেনে নিই; কিন্তু বাংলাদেশের ‘সড়ক দুর্ঘটনা’গুলো তো দুর্ঘটনা নয়, সেগুলো কেন আমরা দিনের পর দিন মেনে নিই?

আমি সিলেট থাকি, মাঝে মাঝেই নানা দরকারে ঢাকা আসতে হয়। বেশিরভাগ সময় গাড়িতে আসি, হিসাব করে দেখেছি ঢাকা-সিলেট না করে যদি সোজা গাড়ি চালিয়ে যেতাম তাহলে এতদিনে পুরো পৃথিবীটাকে অন্তত কুড়িবার পাক খেয়ে আসতে পারতাম। যতবার সড়কপথে গিয়েছি ততবারই মনে হয়েছে যে, আর একটু হলে একটা ভয়ংকর কিছু ঘটে যেত! দৈত্যের মতো বাস-ট্রাক উল্টো দিক থেকে সোজাসুজি আসতে থাকে, ছোট গাড়িকে সরে যেতে হয়। বেশিরভাগ সময় সরে যাওয়ার জন্য রাস্তায় যথেষ্ট জায়গা থাকে না তখন রাস্তার পাশে উঠে যেতে হয়। দৈত্যের মতো বড় বড় বাস-ট্রাক প্রবল প্রতাপে রাস্তা দখল করে চলে যায়। তাদের কেউ কখনও বলেনি রাস্তায় গাড়ি চালানোর নিয়মকানুন আছে, অন্য গাড়িকে রাস্তা থেকে সরিয়ে ওভারটেক করা যাবে না। কেউ এমন করলে কখনও সে জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। পথেঘাটে নিয়মকানুনগুলো জোর করে সবাইকে মানতে বাধ্য করা হলে অনেক মানুষ বেঁচে যেত। বাংলাদেশের পথেঘাটে প্রতিদিন কমপক্ষে ১২ জন গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়, আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই দুর্ঘটনা শব্দটা ব্যবহার করি। যে ঘটনাটি বন্ধ করা সম্ভব, সেটি দুর্ঘটনা নয়, সেটি অপরাধ। যদি সে কারণে কেউ মারা যায় সেটি খুন।

শেষবার যখন ঢাকা থেকে সিলেট আসছি, তখন হঠাৎ রাস্তায় গাড়ির জ্যাম। একটু এগিয়ে দেখলাম এই মাত্র বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। রাস্তার পাশে সারি সারি মৃতদেহ শুইয়ে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর অন্য যে-কোনো দেশে একজন মানুষ হয়তো সারা জীবনে এ রকম একটি ঘটনা একবার দেখে। আমি অনেকবার দেখেছি। যারা আহত তাদের বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যারা মারা গেছে তাদের নিয়ে কোনো ব্যস্ততা নেই। তারা রাস্তার পাশে শুয়ে থাকে। নারী, পুরুষ এবং শিশু। এক মুহূর্ত আগেও তারা জানত না তাদের মেরে ফেলা হবে। মুহূর্তের মাঝে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়, পুরোপুরি জীবন স্বপ্ন এবং আশায় ভরপুর একজন মানুষের সবকিছু শেষ হয়ে যায়।

যারা মারা যায় আমরা তাদের সংখ্যা নিয়ে কথা বলি। যারা আহত হয় তাদের কী হয়? কেউ কেউ পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যায়, কেউ কেউ সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। রাজীব আর মিম যে ঘটনায় মারা গেছে সেখানে আরও নয়জন আহত হয়েছে। তারা কেমন আছে? অন্তত পক্ষে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থাটুকু করা হয়েছে তো?

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি আমার অফিসে কাজ করছি, হঠাৎ একটা ফোন এলো। ফোন করেছে আমার প্রাক্তন ছাত্র এবং বর্তমান সহকর্মী। টেলিফোনে সে ঠিক করে কথাই বলতে পারছিল না, হাহাকারের মতো শব্দ করছিল। কষ্ট করে কথা বলে বুঝতে পারলাম ভয়ংকর মুখোমুখি একটা বাস দুর্ঘটনায় পড়েছে। সে বাসের ভেতর, চারপাশে আহত এবং মৃত মানুষ। একজন রিকশাওয়ালা বাসের জানালা দিয়ে একজন একজন করে আহত মানুষকে বের করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সেভাবে সে-ও শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে পৌঁছেছে, তখন যোগাযোগ করে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা আনা হয়েছিল। ঢাকায় দীর্ঘদিন চিকিৎসায় পর সুস্থ হয়েছে।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার সেই সহকর্মীকে নিয়ে নরসিংদীর সেই এলাকায় গিয়ে খুঁজে খুঁজে সেই রিকশাওয়ালাকে বের করে তার হাত ধরে ধন্যবাদ জানিয়ে আসি যে, একা কারও সাহায্য না নিয়ে সেই বাস দুটির ভেতর থেকে আহত মানুষদের বের করে একজন একজন করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত সেই কাজটি আর করা হয়নি। মাঝে মাঝেই দুঃখ হয়, জীবনের অনেক কাজই শেষ পর্যন্ত আর করা হয়ে ওঠে না।

আমি অনেকদিন থেকে ভেবেছি যে, এ রকম বড় দুর্ঘটনার পর বাসের মালিকদের নামে মামলা করা উচিত। প্রায় সবসময়ই দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলো সত্যিকারের দুর্র্ঘটনা নয়, এগুলো বাসের মালিক, বাসের ড্রাইভার তাদের এক ধরনের দায়িত্বহীনতার জন্য ঘটেছে। যদি মামলা করে বাসের মালিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য বাধ্য করা হয় শুধুমাত্র তাহলেই হয়তো তারা সতর্ক হবে। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য নয়, নিজেদের টাকা বাঁচানোর জন্য তারা একটুখানি দায়িত্বশীল হবে। আমি আমার সেই সহকর্মীকে মামলা করার কথা বলেছিলাম। সে রাজি হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। বাস কোম্পানির অবহেলার অনেক কারণ ছিল এবং সেই অবহেলার কারণে একজন নয়, দুইজন নয়, ষোলজন মানুষ মারা গিয়েছিল। কতজন আহত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত কতজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল তার হিসাব নেই।

আমাদের দেশে মামলা শেষ হতে চায় না। ঠিক সেভাবে এই মামলার রায় পেতেও অনেক বছর চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত মামলার রায় হয়েছে; কিন্তু সেটি আমার সহকর্মীর পক্ষে নয়। আমি অবশ্যি হাল ছেড়ে দিইনি। আশা করে আছি কোনো একবার ঠিক ঠিকভাবে বাস মালিক নামের এই প্রবল প্রতাপশালী মানুষগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হবে। একবার এই দেশে সেই নিয়ম চালু হয়ে গেলে বাস ড্রাইভারদের এই ভয়ংকর দায়িত্বহীনতা হয়তো একটুখানি হলেও বন্ধ হবে। মানুষের প্রাণের জন্য কারও কোনো মায়া-মমতা না-ও থাকতে পারে; কিন্তু টাকার জন্য মায়া-মমমতা নিশ্চয়ই আছে।

আমরা সবাই দেখেছি আমাদের দেশে পরিবহন শ্রমিকদের অনেক ক্ষমতা। তাদের দুর্ব্যবহারের উদাহরণের কোনো শেষ নেই। একজন যাত্রীর সঙ্গে বাকবিত-া হলে তাকে অবলীলায় ধাক্কা দিয়ে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিতে পারে। একজন ড্রাইভার ঠান্ডা মাথায় একজন পথচারীর ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নেয়। ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেল্পার মিলে বাসের ভেতর একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছে কিংবা ধর্ষণ করে খুন করেছে, সেরকম উদাহরণও আছে। মাত্র সেদিন একজন আহত কলেজছাত্রকে নিয়ে ঝামেলা হতে পারে ভেবে তাকে খুন করে পানিতে ফেলে দিয়েছে। পৃথিবীর যে-কোনো সভ্য দেশে উপরের যে-কোনো একটি ঘটনা পুরো প্রতিষ্ঠানের জন্য অস্তিত্বের সংকট হয়ে দাঁড়াত, আমাদের দেশে কিছুই হয় না। একজন শক্তিশালী মন্ত্রী তাদের নেতৃত্ব দেন এবং অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, এই পরিবহন শ্রমিকরা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছে।

কলেজের ছাত্র-ছাত্রী রাজীব এবং মিম মারা যাওয়ার পর আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতিক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত বিচিত্র। তিনি কয়েকদিন আগে ভারতবর্ষে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে সবাইকে (হাসিমুখে) জানিয়েছেন, তারা যদি সেই ঘটনাটি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে আমরা কেন সেটি নিয়ে এত ব্যস্ত হয়েছি! যে সহজ বিষয়টি তার নজর এড়িয়ে গেছে সেটি হচ্ছে ভারতবর্ষের ঘটনাটি ছিল একটি দুর্ঘটনা, আমাদের ঘটনাটি দুর্ঘটনা নয়- সেটি এক ধরনের হত্যাকাণ্ড। একটুখানি দায়িত্বশীল হলেই এই ঘটনা ঘটত না।

আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন সারা দেশের কলেজের ছাত্রছাত্রীরা পথে নেমে এসেছে। তাদের দাবিটি অত্যন্ত মানবিক, আমরা সবাই দীর্ঘদিন থেকে এই একই দাবি করে আসছি। আমাদের সেই কথাগুলো কখনও কেউ গুরুত্ব দিয়ে শোনেনি। কলেজের ছেলেমেয়েরা সেই কথাগুলো শেষ পর্যন্ত সবাইকে শোনাতে পেরেছে। আশা করছি তাদের অত্যন্ত মানবিক দাবিগুলো শোনা হবে, আমাদের দেশটিকে আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর মৃত্যুর উপত্যকা হিসেবে দেখতে চাই না।





About মুহম্মদ জাফর ইকবাল 34 Articles
মুহম্মদ জাফর ইকবাল (জন্মঃ ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫২) হলেন একজন বাংলাদেশী লেখক, পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ। তাকে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখা ও জনপ্রিয়করণের পথিকৃৎ হিসাবে গণ্য করা হয়। এছাড়াও তিনি একজন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক এবং কলাম-লেখক। তার লেখা বেশ কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। তিনি বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং তড়িৎ কৌশল বিভাগের প্রধান।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*