‘পাই’ (Π) কাকে বলে জানো ?

ক্লাশ সিক্স বা তার ওপরে যারা পড়ো তারা অনেকেই হাত তুলবে জানি। ওইটা অংক ক্লাশের একটা বিটকেল জিনিস যেটা দিয়ে বৃত্তের পরিধি, ক্ষেত্রফল এইসব মাপে। এককথায় অংকের যন্ত্র বা টুল একটা।

শোনো বলি তবে। ‘পাই’ কিন্তু অত তুচ্ছ জিনিস নয়। ওর মধ্যে বিরাট এক রহস্য রয়েছে। কিছু একটা ম্যাজিক কাজ করে ওতে। যতবড়োই বৃত্ত হোক না কেন, তার পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে তার মান সবসময় ওই ‘পাই’ এর সমান হয়। তোমার চোখের মণিতে যে হিসেব, গোটা সূর্যটাও সেই একই হিসেব মেনে চলে। একই হিসেব মেনে চলে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না এমন ছোট ডিএন এ তন্তুর প্যাঁচগুলোও, মেনে চলে আলোকতরঙ্গ, শব্দতরঙ্গেরা, মেনে চলে পুকুরে ঢিল ফেললে তার থেকে তৈরি হওয়া গোল তরঙ্গের দল।

শুধু কি বৃত্তের মাপ ?

‘পাই’ আরো অনেক আশ্চর্য জায়গায় দেখা দেয় এসে। যেমন ধরো, তুমি যদি বেশ কয়েকটা পূর্ণসংখ্যা এলোমেলোভাবে বেছে নিয়ে একজায়গায় রাখলে। তারপর তার থেকে যেকোন দুটো পূর্ণসংখ্যা তুললে চোখ বন্ধ করে। এবারে মজাটা হবে এই যে অংক কষলে দেখা যাবে যে দুটো সংখ্যাই তুমি এভাবে বেছে তোলো না কেন, তাদের দুটোকেই ভাগ করা যায় এমন কোন সংখ্যা না থাকবার চান্স সবসময় হবে (৬/π)। কী করে হ য়? কেউ জানে না।

আরো আছে। ধরো একটা নদী। সে চলেছে এঁকেবেঁকে পাহাড় থেকে সমুদ্রের দিকে। তুমি চললে তার দৈর্ঘ্য মাপতে। যদি তুমি দুটো মাপ নাও, একটা হল তার আঁকাবাঁকা স্রোতের মোট দৈর্ঘ্য আর অন্যটা তার উৎসবিন্দু থেকে মোহানা বিন্দুর সরলরেখার দৈর্ঘ্য তাহলে দুনিয়ার সব নদীর জন্যই তার মান হবে ওই π

বোঝাই যাচ্ছে প্রকৃতির নানান বস্তুকে আর তার রহস্যকে বোঝবার জন্যে যত অংক তাতে এই ম্যাজিক নম্বরটার কী বিশাল ভূমিকা। অতএব তার মান বের করতে হবে। চলো শুরু করা যাক। লাগবে একটা সুতো আর একটা স্কেল। কৌটোর ঢাকনা দিয়ে কাগজের গায়ে গোল ছাপ দাও একখানা। তারপর গোলবরাবর সুতো ফেলে পরিধিটা মেপে নাও তার। এবারে বৃত্তটার ঠিক মাঝখানের বিন্দুর ওপর দিয়ে তার পরিধির এপাশ থেকে ওপাশ অবধি লম্বা করে সুতো ফেললেই বেরিয়ে আসবে ব্যাস। তাকেও স্কেলে মেপে নাও।

এবারে প্রথমটাকে দ্বিতীয়টা দিয়ে ভাগ করলেই পাই এর মান—

দাঁড়াও দাঁড়াও। এইবারেই তো খেলা শুরু-

ভাগটা শুরু করলে ধরো। প্রথমে পাবে তিন। দেখবে একটু ভাগশেষ থাকছে। কোই বাত নেহি। একটা দশমিক বসিয়ে শূন্য টেনে এনে ফের করো, আসবে ১। ফের একটু ভাগশেষ থাকবে। মানে নিখুঁত ভাগফলটা পাওয়া যাবে না। এমনিভাবে করতে থাকো, করতেই থাকো—ভাগটা কোনদিন শেষ হবে না। প্রকৃতির এই ম্যাজিকটা, চোখের তারা, সূর্য, মৌলিক সংখ্যার হিসেব কিংবা নদীর দৈর্ঘ্য যেমন সমস্তকিছুকেই যে সংখ্যাটা নিয়ন্ত্রণ করে কিছুতেই তার পুরোপুরি নিখুঁত মান ধরা দেবে না তোমার কাছে। অথচ বিশ্বটাকে ঠিকঠাক মেপেজুপে ফেলতে হলে, তাকে এক্কেবারে ঠিকঠাকভাবে জানতে হলে ও সংখ্যার নিখুঁত মাপ না জানলে চলবেই না। তাহলে উপায়?

মানুষ তার সভ্যতার একেবারে শুরুর দিক থেকেই ক্রমাগত তাই ‘পাই’কে সবটা না হলেও যত বেশি নিখুঁতভাবে ধরা যায় সেই চেষ্টা করে চলেছে। প্রাচীন মিশরীয়রা তার মান বের করতে পেরেছিল মাত্রই দশমিকের পর দু ঘর অবধি—৩.১৪ । তার ফলে ওই সম্পর্কিত সমস্ত মাপজোকের ভুলকে তারা একশো ভাগের এক ভাগের কমে নামাতে পেরেছিল। কিন্তু মহাবিশ্বের নানান রহস্যকে সঠিকভাবে হিসেব করে বোঝবার চেষ্টা করতে গেলে সে ভুলটাও অনেক সময় মারাত্মক হয়ে ওঠে। ওর পরে এক এক ঘর মান বের করতে পারা মানে সেই ভুলের পরিমাণটাকে দশের গুণিতকের হারে কমিয়ে আনা। মানে ৩.১৪ এর পর কোন সংখ্যাটা রয়েছে সেইটে খুঁজে পেলে মানেই হিসেবের ভুলের পরিমাণ কমে গিয়ে হল হাজার ভাগের এক ভাগ।

এখন কমপিউটার আবিষ্কার হবার পর সে মানটা অনেক নিখুঁতভাবে বের করা গেছে। ৩ এর পর দশমিকের পর ৫ ট্রিলিয়নখানা সংখ্যা অবধি যেতে পেরেছে আমাদের কমপিউটাররা। কিন্তু তবু সে ভাগের শেষ মেলেনি। কে জানে, মহাবিশ্বের কোন এক বিরাট রহস্য হয়ত লুকিয়ে আছে ওর মধ্যে।

কিন্তু সভ্যতার যখন সূচনা ঘটছে তখন না ছিল কমপিউটার, না ছিল সুক্ষ মাপজোক করবার মত অংক বা যন্ত্রের হদিশ।

সেই সময়ে বসে আর্যভট একখানা প্রায় অসাধ্যই সাধন করে ফেলেছিলেন বলতে পারো। তিনি পাই এর যে মানটা বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাতে ভুলের পরিমাণ ছিল দশ হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র। পাই-এর মান তাঁর হিসেবে এসেছিল ৩.১৪১৪৬ (এর প্রথম চার ঘর নিখুঁত আর শেষ ঘরটা মোটামুটি আনুমানিক)। আপাতদৃষ্টিতে এই ছোট্টো কাজটা কিন্তু পাই দিয়ে দুনিয়ার নানান মাপজোকের শাস্ত্রটায় ভুলের পরিমাণকে দশ হাজার ভাগের এক ভাগে নামিয়ে আনতে পেরেছিল। কেমন ম্যাজিক?

আজ তবে এই অবধি রইল।





Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*