দেশে শিক্ষিত মানুষের বাম্পার ফলন হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী জিপিএ ৫ ইত্যাদি পেয়ে জাতির মুখ উজ্জ্বল করছে। আমাদের কালের মতো একটা ফার্স্ট ডিভিশন আর দুইখান লেটারের সন্তুষ্টি এখন আর নাই। সেই আমলের স্ট্যাণ্ড, স্টার, লেটার সবকিছুর মর্যাদা এখন ঢাকা পড়েছে জিপিএ গোল্ডেন জিপিএ-র নকশী কাঁথায়। সেই জাতির একজন হিসেবে আমার বুক তিনহাত ফুলে যাবার কথা। কিন্তু আমার নেহাত আধমূর্খ মেধার স্কেলে এই উন্নতির বহরটা ঠিক হিসেব করতে পারছি না বলে গর্বটা অনুভবের বাইরে থেকে যাচ্ছে।আসলে দেশের বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে আমার জ্ঞান প্রাইমারী লেভেলের চেয়েও কম। আমার দুই সন্তান স্কুলের একদম নিন্মপর্যায়ে পড়াশোনা করছে। ছোটটি পড়ছে খেলাপড়া শ্রেণীতে। খেলাপড়া বা প্লে শ্রেণীতে পড়াশোনার বালাই নাই, ঘন্টা দুয়েক খেলাধুলা করে, ছড়া গান গেয়ে, ফুলপাখির ছবি দেখে চলে আসে। সুতরাং চতুর্থ বর্ষীয় পুত্রকে নিয়ে এখনো তেমন ভাবনা নেই পরিবারে। ভাবনা হলো কন্যাটিকে নিয়ে। কন্যাটি একই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। ওর ভবিষ্যত নিয়ে বিশেষভাবে শংকিত ওর মা। আশংকায় ব্লাড প্রেশার পর্যন্ত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় কোন কোন দিন।
বিদ্যালয়ের অন্যসব শিশু ওর চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, বিষয়ে বিষয়ে ক+ পাচ্ছে পরীক্ষার খাতায়, অথচ আমার কন্যা পাচ্ছে শুধু ক কিংবা খ, পড়াশোনার চেয়ে গান ছবি আঁকা ইত্যাদির দিকেই বেশী ঝোঁক তার, কিন্তু শিল্পী হলে তো ভাত জুটবে না। সুতরাং ওর ভবিষ্যত কি হবে, কেমনে মানুষ হবে ইত্যাদি নিয়ে খুব চিন্তিত সে। আমি এই মহৎ দুচিন্তার বাইরে সুখী জীবনযাপন করি। এই ডিপার্টমেন্টের কোন দায়িত্বে নেই বলে আমি নীরব শ্রোতার ভূমিকাতেই থাকি বেশীরভাগ সময়। শুধু গতকালই একটু ব্যতিক্রম হলো। স্কুলের হোমওয়ার্কে একটা প্যারাগ্রাফ লিখতে দেয়া হয়েছে আমার কন্যাকে। ইংরেজী ভাষায় চাঁদকে নিয়ে এক পাতা, সূর্যকে নিয়ে আরেক পাতা সৃজনশীল রচনা লিখতে হবে। এইটুকু বাচ্চা চাঁদসুরুজ নিয়ে বাংলায় কয়টা বাক্য হয়তো লিখতে পারবে, কিন্তু ইংরেজীতে কিভাবে লিখবে সেটা আমার মাথায় এলো না। এদেশে একটা গড়পড়তা এসএসসি পাশ ছেলেও শুদ্ধ ইংরেজিতে একটা সৃষ্টিশীল পাতা লিখতে হিমশিম খাবে।
কিন্তু এটা স্কুলের হোমওয়ার্ক। লিখতেই হবে, কোন উপায় নেই। তাছাড়া স্কুলে ওটার উপর পরীক্ষা নেবে। মায়ের চাপ আর বকুনি খেয়ে কন্যা একসময় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলছে, “মা আমি তিনলাইন লিখেছি, পরের লাইনগুলো কিছুতে মনে করতে পারছি না।” কন্যার আকুতি আমার কান হয়ে বুকের মধ্যে বিদ্ধ করলো। আমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিলাম। বই বন্ধ করে উঠে বসলাম। যদিও এটা আমার দায়িত্বে পড়ে না, তবু অযাচিত নাকটা গলিয়ে বললাম, “একটা ক্লাস টু’র বাচ্চাকে সৃজনশীল ইংরেজী রচনা লিখতে দেয়, এটা কেমন কথা? তাও একটা আদি অকৃত্রিম বাংলা স্কুলে।” স্ত্রী অসন্তুষ্ট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কি জানো ‘ক’দের স্কুলে ক্লাস ওয়ানে এই রচনা লিখিয়েছে, আর ‘খ’দের স্কুলে কেজি থেকেই এই রচনা শেখায়? এখানে তো বরং অনেক দেরী করে ফেলেছে এসব শেখাতে, এতদিন পর ক্লাস টুতে এসে এসব শেখাচ্ছে।” ( ক আর খ আমার দুই ভাগ্নী) উদাহরণ দুটো পেয়ে আমার বিরক্তিটা প্রায় ক্রোধে রূপান্তরিত হল এবং যথাসম্ভব গলা নীচু করে হিসহিস করে বললাম, “যেসব স্কুলে এই শিশুদের মগজে এত কম বয়সেই সৃজনশীল ইংরেজি বিদ্যা ঠেসে ঢুকানোর চেষ্টা চলে, সেই স্কুলগুলোকে তুলে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলা উচিত!” আমার স্ত্রী অসহায়ভাবে বললো, “তুমি চুপ থাকো প্লীজ , তোমার কথা শুনতে পেলে, ও আরো লাই পাবে, একদমই লিখবে না।” আমি চুপ হয়ে গেলাম। কিন্তু ভেতরটা খুব জ্বলতে থাকলো।
এটা কেমন কথা? কিরকম শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে? কোথায় এদের নিয়ন্ত্রণ? একটা বাচ্চা কতটা নিতে পারবে, কতটা পারবে না, সেটা হিসেব না করে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লেগে থাকবে স্কুলগুলো? যে বাচ্চার একটা জিনিস ১২ বছর বয়সে শিখলেও চলে, সেটা তাকে ৭ বছর বয়সেই ঠেসে গিলিয়ে দিতে হবে? এতে শিশুদের মানসিক অবস্থা কী দাঁড়াচ্ছে তার হিসবে কেউ রাখে?
শিশুদের কোন ক্লাসে কি পড়ানো হবে সেটা নির্ধারণের জন্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ড নামে একটা কতৃপক্ষ আছে, শিক্ষামন্ত্রনালয় আছে। তাদের নির্দেশিত বইও আছে, বইগুলো বিনামূল্যে বইগুলো স্কুলে স্কুলে সরবরাহ করা হয়। বোর্ড নির্ধারিত দ্বিতীয় শ্রেণীর তালিকায় দেখলাম তিনটা মাত্র বই।
১. আমার বাংলা বই
২. প্রাথমিক গণিত
৩. English for Today
শিক্ষাবোর্ড ২য় শ্রেণীর বাচ্চাদের জন্য এই ৩টি বই দিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও স্কুলগুলো সন্তুষ্ট নয়। প্রাইভেট স্কুলগুলো তাদের নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থায় চলে। এই তিনটা বইয়ের বাইরে আরো দশ বারোটা বই তাদের যোগ করতে হয়। তারপর সবগুলো বই মিলিয়ে শিশুর মগজের মধ্যে একটা ঘুটা তৈরী করে সেই জ্ঞানের ঘুটা দিয়ে প্রতিটি শিশুকে বিদ্যাসাগর বানাবার ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করা হয়। একটা সাত বছরের শিশুর মাথার ভেতরে এত ইংরেজী বিদ্যা, এত ভূগোলবিদ্যা, এত ইতিহাস, এত বিজ্ঞান, এত সমাজতত্ত্ব, এত মানবতত্ত্ব কতক্ষণ পর্যন্ত টিকে থাকে? একঘন্টা, একদিন, একমাস? নাকি এক বছর? এতসব জিনিস পড়তে গিয়ে, লিখতে গিয়ে, শিখতে গিয়ে শিশুটির খেলাধুলার সময় পর্যন্ত থাকে না। শিশুদের শৈশব ধ্বংসকারী এই বিদ্যাসাগর কর্মসূচীকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারের কোন সংস্থার কোন দায়িত্ব নেই?
যদি বোর্ডের বইগুলো জ্ঞানার্জনের জন্য যথেষ্ট না হয়, তাহলে শিক্ষাবোর্ড ওই বইগুলোর বাইরে আর কোন বই দেয় না কেন? নাকি ওই তিনটা বই শুধু সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরিদ্র ছাত্রদের জন্যই, যাদের বিদ্যাসাগর হবার দরকার নেই? কথাটা ভারসাম্যহীন মনে হতে পারে, তবু বলছি। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমি আমার সন্তানদের প্রচলিত এসব স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের
হাতে আদিযুগের টোল মক্তবের মতো জ্ঞানদান করতাম । আমি যে ক’পাতা পড়াশোনা করেছি তাতে অন্ততঃ এটুকু বুঝি আমার সন্তান কোন বয়সে কতটুকু শিখতে পারবে, জীবনের কোন ক্ষেত্রে কতটুকু প্রয়োজন। সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষার সবটুকু জ্ঞান প্রদানের ক্ষমতা আমার আছে। শুধু সার্টিফিকেট দেবার ক্ষমতা নেই যা নিয়ে সে পরবর্তী সার্টিফিকেটের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে। শিক্ষাজীবন শেষে তার জীবিকার উপায় করবে সার্টিফিকেট নামের সেই টুকরো কাগজটা। আমরা শুধু এক টুকরো ছাপানো কাগজের শক্তির জন্য আমার সন্তানকে বিদ্যালয় নামের অসুস্থ সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছি? বিক্রি করে দিচ্ছি তাদের শৈশব, তাদের আনন্দ, তাদের সকল সৃষ্টিসুখের উল্লাস?
১৮-০৫-২০১৪ খ্রিঃ
সরকারী সফর আলী কলেজ
আড়াইহাজার,নারায়নগঞ্জ
লেখক- সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মাসিক জাতীয় শিশু-কিশোর হাতেখড়ি
Leave a Reply