দেশভাগের পর থেকে রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল রংপুরবাসীর। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি আবার জোরালো হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ রংপুরবাসীর আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিবেচনা করে ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন (যদিও বর্তমানে সেই নামফলক এখন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না)। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক এম লুৎফর রহমানকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের জন্য ৯৯ কোটি টাকা অনুমোদন দেয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত অবকাঠামোগত কোনো কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেনি। বরং রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় করে। যদিও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কখনো নিজের নামের সঙ্গে সচেতনভাবে ‘বেগম’ শব্দটি লেখেননি। সব বিভাগে রোকেয়া স্টাডিজ পড়ানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও পড়ানো হয় না।
দৃশ্যত কোনো কারণ ছাড়াই প্রথম উপাচার্যকে অব্যাহতি দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক মু. আবদুল জলিল মিয়াকে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হওয়া উচিত, উপাচার্য হিসেবে তাঁর কী দায়িত্ব, সবকিছুই তিনি ভুলে যান এবং বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। তিনি যোগদানের এক বছরের মধ্যে প্রথম আলোয় ‘এটি একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামের খবর হয়েছিল।
সরকার তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে তিনি আত্মীয়বৃত্তের পরিধি বাড়াতে থাকেন, যা চল্লিশ সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় নিয়োগ-বাণিজ্য। এসব করতে গিয়ে তিনি কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেননি। নিয়ম-নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি ‘নর্থ বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। যার সনদ দেওয়ার কথা ছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর মালিকানা ছিল তাঁর সঙ্গে তাঁর মেয়েরও। কয়েকজন শিক্ষক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থী এর বিরোধিতা করে আন্দোলন করেন। আন্দোলন বন্ধ করতে তৎকালীন উপাচার্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পেটোয়া বাহিনীর দ্বারা আঘাত করেন, তাঁদের অনেককে সাময়িক বরখাস্ত করেন, ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করেন। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের জামায়াতি সাজানোর চেষ্টাও কম হয়নি। শেষ পর্যন্ত সরকার উপাচার্যের মেয়াদ পূর্তির আগেই অব্যাহতি দেয়। যখন তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাউন্টে সাত-আট কোটি টাকা থাকার কথা থাকলেও ১৩৮ টাকা ছিল মাত্র। বর্তমানে তিনি দুদকের মামলায় অভিযুক্ত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি থেকেও তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়।
অপরিকল্পিতভাবে মাত্র ছয় বছরে ২১টি বিভাগ খোলা হয়েছে। এতগুলো বিভাগ আর এত শিক্ষার্থীর জন্য যে পরিমাণ সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি। শিক্ষকের সংখ্যা যেমন কম, তেমনি বইয়ের সংখ্যাও খুবই নগণ্য। একেকটি বিভাগে তিন থেকে সাতজন শিক্ষক যখন ছয়টি ব্যাচের ক্লাস নিয়েই ক্লান্ত, তখন ইভিনিং এমবিএ চালু করা হয়েছে। অথচ অনেক বিভাগে শিক্ষক ও ল্যাবের দাবিতে আন্দোলনও চলছে।
প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এখন স্থানসংকটে পড়েছে। রংপুরের পশ্চাৎপদ এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল অত্যন্ত প্রয়োজন। একজন শিক্ষার্থীকে অনেক টাকা ব্যয় করে মেসে থাকতে হয়। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল এবং শহীদ মুখতার এলাহী হলে কয়েক শ শিক্ষার্থী অনায়াসেই থাকতে পারেন। আবার যে ভবনগুলো গড়ে উঠেছে, সেগুলো বাইরে থেকে সুন্দর মনে হলেও প্রয়োজন উপযোগী করে নির্মাণ করা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিভাগগুলোতে দেড় শ-দু শ শিক্ষার্থী পড়ে, অপরিকল্পিত কক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেখানে ৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান করেছেন একজন অনভিজ্ঞ ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। আর এর কাজ বাস্তবায়ন করে শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এদের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে ভবন পরিকল্পনা বিশ্ববিদ্যালয় মানে উন্নীত হতে পারেনি। মাস্টারপ্ল্যানে পরিবর্তন এনে ভবনকাঠামো পরিবর্তন করে নতুন আরও অনেক ভবন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার নামে একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট খোলা হয়েছে। সেখানে নামমাত্র গবেষণার জন্য এমফিল এবং পিএইচডি কোর্স চালু করা হয়েছে। জনবল নিয়োগ দিয়েই এখানকার কাজ শেষ করেছেন দ্বিতীয় উপাচার্য মু. আবদুল জলিল মিয়া। তৃতীয় উপাচার্য অধ্যাপক এ কে এম নুর-উন-নবী দায়িত্ব গ্রহণের অনেক দিন হলেও এ ইনস্টিটিউটটির গবেষণা কার্যক্রমের কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্য নেই। কোষাধ্যক্ষ ড. এম এ ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক, বহিরাঙ্গন পরিচালক, ছাত্র উপদেষ্টা, কোনো কোনো অনুষদে ডিন, পরিবহন পুলের পরিচালক, অনেকগুলো বিভাগে বিভাগীয় প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প পরিচালকসহ অনেক পদের দায়িত্বে রয়েছেন উপাচার্য নিজেই। তিনি প্রশাসনিক কাজে অনেক সময় ঢাকায় থাকেন। যখন তিনি ঢাকায় থাকেন তখন একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। রেজিস্ট্রারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন একজন সহকারী রেজিস্ট্রার। এক বছর আগে অনার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরও কোনো কোনো বিভাগে এমএ কোর্সের জন্য কোনো নীতিমালা করা হয়নি বলে ক্লাস এখন পর্যন্ত শুরু করা যায়নি। এসব কারণে পদগুলো পূরণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় বছরে কোনো মিলনায়তন হয়নি, জিমনেসিয়াম হয়নি, এমনকি মাস্টারপ্ল্যানেও তা নেই। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জন্য নির্দিষ্ট বসার ব্যবস্থা নেই।
এ বিশ্ববিদ্যালয়টি আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সে জন্য গবেষণাবান্ধব প্রশাসন জরুরি। তাজহাট জমিদারবাড়ি এবং রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এখানে অনেক মেধাবী তরুণ শিক্ষক রয়েছেন, যাঁদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে মানসম্মত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব। সাবেক উপাচার্য এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে যে গভীর সংকটে ফেলেছিলেন, তা থেকে উত্তরণে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wadudtuhin@gmail.com
প্রথম আলো’তে পূর্বে প্রকাশিত
Leave a Reply