গ্রন্থ পর্যালোচনাঃ মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর
–অধ্যাপক মহিবুর রহিম
লোকসাহিত্য গবেষক।
বাঙালী কবির গীতি প্রবণতা বা গীতিধর্মীতা আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। ভাবের সুরের সম্মিলন ঘটানো আসলে ভাবকেই জোরালো প্রাণবন্ত করার একটা প্রচেষ্টা চর্যাপদের কবিদের ও বৈশিষ্ট। তারা কাব্যকে গীতিধর্মীতায় উত্তীর্ণ করেছিলেন। শুধু চর্যাপদের কবিদের কথাই বলব কেন- আমাদের রবীন্দ্র-নজরুল এমন কি শামসুর রাহমানের মধ্যে ও কাব্যের উৎকর্ষতার পাশাপাশি তাদের সঙ্গীতমনস্কতা বিশেষভাবেই লক্ষণীয়। আমরা হাজার বছরের বাংলা কবিতার পাঠ থেকে এই সত্য অনুধাবন করি বাঙালী কবি মাত্রই ভাব ও বিষয়কে মুক্তি দিতে সুরের আশ্রয়ী। যে সুর পাঠক ও শ্রোতাকে গভীরভাবে আপ্লুত করে, বাঙালী কবির পক্ষে সে সুরের আশ্রয়ী হওয়া অতি স্বাভাবিক| বাংলা কবিতা বিচিত্র শৈলী ও প্রবণতায় আজ ঋদ্ধ।
মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর একটি আধুনিক ধারার সঙ্গীত সংকলন। এগুলোকে গীতধর্মী কবিতা ও বলা যায়। তবে স্বার্থক সঙ্গীতের জন্যে কাব্যগুণের শর্ত তো খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। গ্রন্থটির লেখক শফিকুল ইসলাম মূলত একজন কবি। কবিতা নিয়েই সাহিত্য জগতে তার পদযাত্রা।এই ঘর এই লোকালয়, একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি, শ্রাবণ দিনের কাব্য, তবু ও বৃষ্টি আসুক,- প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে তার স্বতন্ত্র¿ কাব্য প্রবণতা বিশেষভাবে বিবেচনার দাবী রাখে। আর একজন কবির রচিত সঙ্গীত গ্রন্থে ভাব ও সুরের মিশেলে আমরা পেয়ে যাচ্ছি সংবেদনশীল হৃদয়ানুভূতিকে। শফিকুল ইসলামের কাব্যচর্চ্চার মূল বিষয় ও হৃদয় চর্চ্চা। তিনি বিষয়কে হৃদয় রসে জারিত করে প্রকাশে প্রাণান্ত হয়েছেন। এজন্যই তার এ সঙ্গীত গ্রন্থে ও বিষয়ের মুক্তি ঘটেছে বিশেষভাবেই।
তোমার হাসি দোলা দিয়ে যাক বন্ধু অধরের কোণে
আমার আখীজল ঢাকা থাক বন্ধু গোপনে।
তোমায় সুখী দেখলে
আমি সব দুঃখ যাই ভুলে
স্বপ্ন শুধু ছড়িয়ে থাক ও দুটি নয়নে॥
মানব হৃদয়ের চিরন্তন প্রেম-বিরহ, অনুরাগ-বিরাগ, আশা-হতাশা সব কিছুকে লেখক গভীর দরদে স্থান দিয়েছেন তার লেখায়। প্রেম সৃষ্টির একটি অন্যতম নিয়ামক। প্রেম হৃদয়কে বিচিত্র অনুভূতির মুখোমুখি করে। কখনো বিপুল দুঃখ যাতনায় হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে এবং সমৃদ্ধ করে। তাই প্রেমিক হৃদয়ের আর্তিগুলো হয় নিখাদ মনের স্বচ্ছ সুন্দর প্রকাশ। শফিকুল ইসলামের লেখায় চমৎকার সব অনুভূতির শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে।
এক পশলা বৃষ্টিতে হয়ে যায় শরতের আকাশ নির্মল
শত বর্ষায় ও কি ফুরাবেনা আমার আখিজল?
হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ায়
প্রদীপশিখা নিমেষে নিভে যায়
শত দীর্ঘশ্বাসে ও নিভে না আমার বুকের অনল॥
বাংলা গানের এক আধুনিক রূপকার আবু হেনা মোস্তফা কামালের সাথে কবিতা ও গান নিয়ে কথা বলার কিছু সুযোগ আমার হয়েছিল। আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যার তার রচিত গানে যে কাব্যধর্মীতার প্রবর্তন করেছিলেন এই প্রবণতাকে তিনি বাংলা গানের নতুন মুক্তির সন্ধান বলে মনে করতেন। আমার কাছে তার এই ধারণা খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে। শফিকুল ইসলামের লেখায় এই কাব্যধর্মীতার সমণ্বয় আমাকে আশাণ্বিত করেছে।
আমি অন্ধকার আকাশের তারা, আধারের মাঝে জ্বলি একা একা
আমার গোপন কান্না রাতের গহন আধারে থাকে ঢাকা ॥
নয়নে আমার কত যে ছিল আশার স্বপন
আজ স্বপ্ন আমার ভেঙ্গেছে, ভেঙ্গেছে মন
অশ্রুভেজা আজ এ দুটি আখি কাজল আকা॥
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জনপ্রিয় বাংলা আধুনিক গানের যে সব বৈশিষ্ট্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় শফিকুল ইসলাম সেই আধুনিক গানের ধারাতেই নিজেকে যুক্ত করতে চেয়েছেন। এ ধারার গানগুলো বিশেষত মননধর্মী। নিসর্গ আশ্রয়ী ক্যানভাসে সুখদুঃখ, বিরহ-বেদনা মূর্ত করে তোলা হয় এসব গানে । উপমা আর চিত্রকল্পে একটি হৃদয়স্পর্শী অনুভূতির ও সন্নিবেশ ঘটে।
প্রহরের পর প্রহর কেটে যায় আমি একা জেগে থাকি
তারা-ভরা আকাশের পানে মেলে স্তব্ধ নির্বাক দুটি আখি ॥
কখনো হঠাৎ আসা পবনে
দোলা লাগে ঝাউবনে-
কি যে ঝড় বয়ে যায় আমার প্রাণে
গন্ধশেষ দগ্ধ ধূপের মত আমি একা পড়ে থাকি॥
কিংবা-
এই মন হয় রঙিন তোমার কাছে এসে
কথাগুলো গান হয় তোমাকে ভালবেসে ॥
এই নয়নে যখন রাখো দুনয়ন
এই কাধে হাত রাখো যখন-
মন হারায় কোন স্বপনের অজানা দেশে ॥
কিংবা-
যতবার ভাবি আর পিছু ডাকবনা
দুচোখের জল আর কিছুতে মানে না মানা ॥
জানি পিছু ফিরে তাকাবার
নেইতো আজ অবসর তোমার
নয়ন ফেরানো যায় যদি মন তো আর ফেরানো॥
গানের চূড়ান্ত মুক্তি হতে পারে যথার্থ সুরারোপে মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর গ্রন্থের শতাধিক গানের যথার্থ সুরারোপ গানগুলো মননশীল ধারার শ্রোতাদের মুগ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস। শফিকুল ইসলাম নীরবে নিভৃতে যে শিল্পবোধ গড়ে তুলেছেন গ্রন্থটি পাঠ করে তার অনায়াসে উপলব্ধি করা যায় মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর গ্রন্থের লেখাগুলোকে লিরিক কবিতা হিসাবে ও বিবেচনা করা যায়। তবে যে ভাবেই বিবেচনা করিনা কেন শফিকুল ইসলামের বেদনাহত হৃদয়ের সংরক্ত শিল্পনির্যাসই এখানে মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর হয়ে ধরা দেয়।
Leave a Reply