বাল্য বিবাহ ও নারীশিক্ষা নিয়ে ভাবার এখনই সময়

বাল্যবিবাহ

মানুষের জন্ম-মৃত্যুর মত বিবাহ প্রকৃতির এক অলংঘনীয় বিধান। জন্ম নিলে মরতে হয়। আর জীবন মৃত্যুর মাঝখানে সীমিত সময়ের জন্য যতদিন মানুষ বেঁচে থাকে, তার মধ্যে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য বংশ বিস্তার করতে হয়। বয়ঃপ্রাপ্তির সাথে সাথে জৈবিক প্রবৃত্তি বশতঃ মানুষ জীবনে সঙ্গী নির্বাচন করতে চায়।

বাল্যবিবাহজীবনে সঙ্গী নির্বাচন ও জৈবিক চাহিদা পূরণের সব চেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হল বিবাহ। বিবাহ হল এমন এক পন্থা, যেখানে এক বা একাধিক নারী-পুরুষ একত্রে জৈবিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে অপেক্ষাকৃত স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং তারা তাদের জৈবিক চাহিদা পূরণের সাথে-সাথে সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালনের ব্যবস্থা করে।

বিবাহ মানব প্রবাহে অতি প্রয়োজনীয় হলেও অল্প বয়সে বিয়ে বা ‘বাল্যবিবাহ’ সমাজ ও রাষ্ট্রে মন্দ প্রভাব ফেলে। বাল্য বিবাহের ফলশ্রুতিতে জনসংখ্যার আধিক্যে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতিই সৃষ্টি করে না, বরং বাল্য বিবাহ শিশুর শিক্ষা জীবনকে সংকুচিত করে; মানুষ শিক্ষা নামক মৌলিক আধিকার থেকে বঞ্চিত হয় বা অধিকারটি সীমিত করে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যেহেতু কন্যা শিশুরা বেশী করে বাল্য বিবাহের শিকার হয়, সেহেতু বাল্য বিবাহের দ্বারা, বেশীরভাগ নারীর শিক্ষা জীবন শিশু বয়সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অংশীদার হিসাবে নারীরা পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। যার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের বৈষম্যসহ নানাবিধ অনাসৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরী হয়।

প্রকৃতিতে অন্যান্য প্রাণীর মত মানুষও জৈবিক প্রবৃত্তি বশতঃ ভিন্ন লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে নির্দিষ্ট বয়স সীমা পার করার সাথে সাথে। মানুষ ছাড়া আন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে ভিন্ন লিঙ্গের সাথে মিলিত হওয়া ও বংশ বিস্তারের অধিকারটি নির্ধারিত হয় তার বয়ঃ প্রাপ্তি বা দৈহিক সক্ষমতা লাভের সাথে সাথে। কিন্তু আধুনিক সভ্য ও শিক্ষিত সমাজে, কেবল মানুষের দৈহিক সক্ষমতাই জৈবিক চাহিদা পূরণ ও সন্তান উৎপাদনের আধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে -একমাত্র কথা নয়। বরং দৈহিক সক্ষমতার সাথে সাথে, মানসিক ও আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের পর, কোন সমাজের বসবাসরত নারী বা পুরুষকে আইন, ধর্ম ও নৈতিকতা সম্মত জৈবিক চাহিদা পূরণের ও সন্তান উৎপাদনের অধিকার দেয়।

বাংলাদেশের মত জনবহুল একটি দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও মানব সম্পদ উন্নয়নের স্বার্থে, নারী-পুরুষের আইন সম্মত বিবাহের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ১৬ ও ১৮ বছর। বাল্য বিবাহ নিরোধ ও নিরুৎসাহিত করণের জন্য প্রণীত আইনটিতে বিবাহের যে বয়স সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে নারীর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা সমাপ্তির সুযোগ থাকলেও আইন সম্মত বিবাহ ও বিবাহ পরবর্তী অনেক সমস্যায়, নারীর উচ্চ শিক্ষা বিঘ্নিত হয় বা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সীমিত হতে হতে নাগালের বাইরে চলে যায়। যদিও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা গ্রহণে নারী ও পুরুষের সংখ্যার পার্থক্য খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু উচ্চ শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহন বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে হতাশাজনক।
মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার শুরু থেকেই বাল্য বিবাহ ও অন্যান্য আর্থ-সামাজিক কারণে কন্যাশিশুরা ঝরেপড়তে শুরু করে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা জীবন সফলভাবে শেষ করার আগেই দেশের বেশীরভাগ কন্যা শিশুরা বাল্য বিবাহের ফাঁদে পড়ে শিক্ষা জীবনের ইতি টানতে বাধ্য হয়।

শহরাঞ্চলে নারীর উচ্চ শিক্ষায় অংশগ্রহণ কিছুটা ভাল হলেও গ্রামাঞ্চলে ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বা এলাকায় নারীর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের হার খুব সামান্য। প্রাথমিক শিক্ষা ভাল ভাবে সম্পন্ন না করেই যখন মাধ্যমিক পর্যায়ের কন্যা শিশুরা দরিদ্র্যতা সহ বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে, স্বেচ্ছায় বাল্য বিবাহ সম্পর্কে আবদ্ধ হতে হয় বা বাল্য বিবাহের শিকার হতে বাধ্য হয়। তখন গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর হতে থাকে। বাল্য বিবাহ সহ অন্যান্য কারণে শিক্ষায় যখন নারীরা পিছিয়ে পড়ে, তখন শিক্ষা হীনতা বা স্বল্প শিক্ষাগত দক্ষতার কারণে তারাপর বর্তীতে অন্যান্য মৌলিক চাহিদাগুলো অর্জনেও পিছিয়ে পড়ে, বা অধিকারগুলো অর্জনের ব্যাপারে পরমুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। যার ফলে নারীর ক্ষমতায়ন ওসমান অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টিতেও রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যার্থ হয়। যদি রাষ্ট্র ও সমাজে ‘নারী-পুরুষের সাংবিধানিক সমানাধিকার’ ধারণাটির সঠিক বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়, তাহলে সকল পর্যায়ের শিক্ষাকে, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাকে আরো বেশী নারীদের কাছে প্রসস্থ ও সহজলভ্য করা প্রয়োজন। বাল্য বিবাহ দ্বারা আক্রান্ত নারী সহ সকল মানুষের জন্য, সকল স্তরের শিক্ষার ন্যূনতম সুযোগ কীভাবে সৃষ্টি করা যায়, সেটাই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের আজকের ভাবনা হওয়া উচিত।
আজকে আমাদের এমন এক সমন্বিত ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে, যাতে বাল্য বিবাহ ও অন্যান্য কারণে ঝরে পড়া কন্যা শিশু সহ ঝরে পড়া সকল শিক্ষার্থীকে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পদ্ধতির বাইরেও বিকল্প কোন পদ্ধতির মাধ্যমে, কার্যকরভাবে সকল স্তরের শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।





About অরণ্য সৌরভ 47 Articles
আমি অরণ্য সৌরভ, লেখাপড়া করছি সরকারী সফর আলী কলেজ আড়াইহাজার, নারায়নগঞ্জ। পাশাপাশি কবি ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছি মাসিক "হাতেখড়ি"তে showrov2500@gmail.com

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*