উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সারা জীবনের লালিত স্বপ্নপূরণের ওই পরীক্ষা মাধ্যমিক অথবা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার থেকে একেবারেই ভিন্ন।
এই পরীক্ষায় সামান্যতম দুর্নীতিও একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর বদলে একজন দুর্বল শিক্ষার্থীকে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। যদি কোনো শিক্ষার্থী মেধা পরীক্ষার পথে না গিয়ে অবৈধ পথে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, তবে সেটি অন্য পরীক্ষার্থীকেও ওই পথে হাঁটতে উৎসাহিত করবে। আর এভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দুর্নীতিমুক্ত বলে আমরা যে গর্ব করি, তা হতাশার জম্ম দেবে। তাই ভর্তি পরীক্ষাকে দুর্নীতির কালো ছায়া গ্রাস করার আগেই এর শিকড়সহ মূলোৎপাটন করতে হবে। যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুর্নীতিমুক্ত ভর্তি পরীক্ষা নিশ্চিত করতে সর্বদাই সচেষ্ট রয়েছে। বিসিএসসহ প্রায় সব ধরনের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের মহোৎসব চললেও ভর্তি পরীক্ষা সেই কলঙ্ক থেকে প্রায় মুক্ত বলা চলে। শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ভর্তি পরীক্ষায় দায়িত্বশীলদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও গোপনীয়তা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টার ফলে এখনো পর্যন্ত (দু-একটি বিছিন্ন ঘটনা ছাড়া) এই সুনাম রাখা সম্ভব হয়েছে।
তবে প্রায়ই মোবাইল, ঘড়ি, হেডফোন অথবা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে একটি চক্র শিক্ষার্থীদের কাছে উত্তর সরবরাহের চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় পরির্দশকের দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষকদের কঠোর নজরদারির কারণে তা প্রতিহত করা সম্ভব হয়। তবে প্রতি ভর্তি পরীক্ষায় ওই ধরনের ডিজিটাল ডিভাইসসহ পরীক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনাই বলে দিচ্ছে যে এ ধরনের জালিয়াতি এখনো চলছে। তাই শিক্ষকদের উচিত আরো সর্তক ভূমিকা গ্রহণ করা।
ভর্তি পরীক্ষায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় খুবই তৎপর। এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশের একটি মাত্র পথ থাকায় পরীক্ষার্থীদের কঠোর নজরদারি ও তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয়। ফলে কোনো ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস বহন করলে প্রবেশপথেই ধরা পড়ে যায়। এ ছাড়া প্রশ্নপত্রে কোনো সেট না থাকায় বা বারকোড পদ্ধতি ব্যবহার করায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতির সুযোগ একেবারে নেই বললেই চলে।
দুই.
ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে জালিয়াতমুক্ত ও প্রশ্নপত্রে বারকোড পদ্ধতি প্রবর্তন করলেই ভর্তি পরীক্ষা শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত হবে- এমন নিশ্চয়তা প্রদান করা কঠিন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ওই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নপত্রে বারকোড পদ্ধতি প্রবর্তন ও ক্যাম্পাসে কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও দুর্নীতিমুক্ত হচ্ছে- এমনটি দাবি করা যাচ্ছে না। কারণ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাত্র ১০ শতাংশ পরীক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। বাকি প্রায় ৯০ শতাংশ পরীক্ষার্থী ঢাকার বিভিন্ন স্কুল অথবা কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে থাকে। সেখানে যাঁরা ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা সবাই ওসব স্কুল ও কলেজের শিক্ষক। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বাইরের কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ওসব স্কুল ও কলেজের শিক্ষকরা ভর্তি পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করেন নামমাত্র (সবাই নন)। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে যেমন কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা থাকে, ওসব কেন্দ্রে তার কোনো বালাই নেই। কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পরীক্ষার্থীদের কঠোর তল্লাশির মুখে পড়তে হয় না। ফলে অনায়াসে যে কেউ ডিজিটাল প্রযুক্তি সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে পারে।
পরীক্ষার হলের চিত্র আরো ভয়াবহ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কক্ষে একাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করলেও বাইরের কেন্দ্রগুলোতে অধিকাংশ কক্ষে একজন শিক্ষক ওই দায়িত্ব পালন করেন। পরীক্ষাসংক্রান্ত অন্য দায়িত্ব (যেমন উত্তরপত্রে স্বাক্ষর, প্রবেশপত্র সংগ্রহ ও ছবির সঙ্গে চেহারা মিলিয়ে দেখা, শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু বুঝতে না পারলে তার জবাব দেওয়া ইত্যাদি) পালন করতে গেলেই এক ঘণ্টা সময় চোখের পলকেই ফুরিয়ে যায় বলে ওই শিক্ষকের পক্ষে পরীক্ষার্থীদের ওপর নজরদারি করা সম্ভব হয় না। ফলে ওই সময়ের মধ্যে পরীক্ষার্থীরা সহজে অন্য পরীক্ষার্থীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে অথবা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে সঠিক উত্তর দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে এক পরীক্ষার্থীর সঙ্গে অন্য পরীক্ষার্থীর আলাপ করার জন্য ঘাড় ঘোরানোরও প্রয়োজন পড়ে না। ওই স্কুল বা কলেজে পরীক্ষার্থীদের এমন গাদাগাদি করে বাসনো হয় যে ঘাড় ঘোরানোর জায়গা পর্যন্ত থাকে না। যেসব কক্ষে মাত্র ২০ জন পরীক্ষার্থী বসানো কষ্টসাধ্য, সেখানে ৫০ জনের অধিক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। প্রতি পরীক্ষার্থীর জন্য ৫০ টাকা হারে বাইরের কেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্রভাড়া প্রদান করার কারণে তাদের চেষ্টা থাকে পরীক্ষার হলে দুরমুজ দিয়ে পিটিয়ে হলেও অধিক হারে পরীক্ষার্থী বসানোর ব্যবস্থা করা। কারণ তারা যতজন পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নিতে পারবে, ততজনেরই টাকা পাবে।
ফলে যতই বারকোড যুক্ত প্রশ্ন থাকুক না কেন, পরস্পর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া পরীক্ষার্থীদের জন্য কঠিন হয় না। এ কথা ঠিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষকরা কেন্দ্রগুলোর বিভিন্ন কক্ষ পরিদর্শন করেন। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে প্রতিটি কক্ষ পরির্দশন করতে গেলে শিক্ষকদের পক্ষে একটি কক্ষে কয়েক মিনিটের বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। যথাযথ তদারকির অভাবে অনেক কক্ষেই পরীক্ষার্থীরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়। ফলে বাইরের কেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা সহজে দুর্নীতির সুযোগ পায়, যা পরীক্ষার্থীদের মেধার যথাযথ মূল্যায়নের সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
ওপরে ভর্তি পরীক্ষার যে চিত্র তুলে ধরেছি, তা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরের কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সেখানেও ভর্তি পরীক্ষার্থীদের সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে তাদের ভর্তি পরীক্ষাও ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে অনুষ্ঠিত হয়। ইতিমধ্যে উপরোক্ত অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজকে ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে না। কিন্তু একটি বা দুটি কলেজকে বাদ দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে- এমনটি ভাবার কারণ নেই। ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকার একটি নামকরা কলেজে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেছি, ওই কলেজও ঢাকা কলেজ বা ইডেন কলেজ থেকে একেবারেই আলাদা- এমন নয়। অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপেও অন্য কেন্দ্রগুলোর একই চিত্র পেয়েছি।
পরিশেষে ভর্তি পরীক্ষার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবার অনুরোধ করছি এবং ক্যাম্পাসের ভেতরে সব শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উপায় খুঁজে বের করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
লেখক : মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও
সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply