মাননীয় রাষ্ট্রপতি,
পত্রের প্রথমে আমার সালাম নিবেন। সরাসরি আপনার ঠিকানায় চিঠি লিখার দুঃসাহস হয়ত আমার এখনও হয় নি। আবার আপনার কাছে না লিখেও পারছিনা।
বাংলাদেশের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষাও আছে। দেশে বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৫৭.৯%, তবে উচ্চ শিক্ষার হার তার অর্ধেকেরও কম।
একটি দেশকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে উচ্চ শিক্ষার কি পরিমাণ দরকার তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালেই বুঝা যায়।
বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ বিদেশ থেকে যে পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠায় শ্রীলংকার তিন লাখ শ্রমিক তার তিন গুণ রেমিটেন্স আহরণ করে। এটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র তাদের উচ্চ শিক্ষিতের জন্য। কারণ তাদের দেশে শিক্ষিতের হার ৯৮.১%।
শিক্ষার মর্ম বুঝতে পেরেই নেপোলিয়ান বলেছিলেন “আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি দিব।”
এটা কেন বলেছিলেন তার মর্মারথ এবং সারকথা হয়ত সবাই বুঝবে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রত্যেক দেশে যত বেশি সুশিক্ষিত লোক থাকবে সেই দেশ তত বেশি উন্নত হবে এটাই বিজ্ঞান সম্মত কথা। ভনিতা না করে আসল কথায় আসি। আমি একজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাবা-মার তিন সন্তানের মধ্যে আমি সবার বড় এবং পরিবারে আয়ের উৎস বাবা একজন। যা বেতন পান তা দিয়ে বাবার খরচ এবং পরিবারের জন্য ব্যয় হয়ে যায়।
অনেক কষ্টে টাকা সাশ্রয় করে কিভাবে জানি আমাকে প্রতি মাসের ১০-১২ তারিখের মধ্যে টিউশন ফি গুলো পাঠিয়ে দেয়। বাকি গুলো নিজে ম্যানেজ করে নিই। তার পরও বাবা ফোন করে বলে টাকা কি আর লাগবে, লাগলে বল।
হায়রে সামান্য কয়টা টিউশন ফির টাকা দিতে (অর্থমন্ত্রীর মতে) অবস্থা বেগতিক তার উপর আরও ভ্যাট। আসলে পৃথিবীর সমস্থ বাবাই হয়ত প্রত্যেক সন্তানকে এমন বলবে।
সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ৭.৫% ভ্যাট আরোপ করেছে যার প্রভাব পড়েছে আমাদের মত দরিদ্র বাবার সন্তানের উপর। আর তা গিয়ে পড়েছে আমাদের বাবার উপর।
নিজের ইচ্ছা ছিল উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দেশের কাজে কিছুটা হলেও ব্যবহৃত হব। কিন্তু সেই স্বপ্ন কিছুটা বিলীন হতে শুরু করেছে সামান্য কয়টা (অর্থমন্ত্রীর মতে) টাকার সাথে ভ্যাট দিতে পারব না বলে!
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমার যত টুকু মনে পড়ে ক্লাস ওয়ানে যখন ভর্তি হই তখন আমরা ছাত্র ছাত্রী ছিলাম দুই শতাধিক। এস, এস, সি পাশ করার সময় তা দাঁড়িয়ে হয় ৭০জন এবং শেষ পর্যন্ত উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন সংখ্যাটার অবস্থা বড়ই নাজুক। তা নেমে হয়ে গেছে বিশের কিছু বেশি।
কিছু বুঝতেছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি?
ক্লাস ওয়ানে দুই শতের অধিক আর উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছি মাত্র বিশের কিছু বেশি! বাকিরা কোথায়?
তারা আমাদের থেকে কোন অংশে কম ছিল না। তারাও আমাদের মত আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারত। পারেনাই বাবা লেখাপড়ার খরচ বহন করতে না পারার কারণে। তারা সবাই আজ চাকরি করছে বাইরে থেকে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের কাজে কিছুটা হলে অবদান রাখছে।
তরুণ কবি সুকান্তের মতে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী যেহেতু শিক্ষাকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখানো হয়েছে তাই রীতিমত শিক্ষা ক্ষেত্রে ভ্যাট কোন দিনই বৈধ হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সেই আইনের তোয়াক্কা না করে সরাসরি পণ্যের মত শিক্ষাতেও ৭.৫%ভ্যাট বসিয়ে দিল।
আজ ভ্যাটটা যে প্রবর্তন করেছিল তাকে গালি দিতে ইচ্ছা করছে কিন্তু পারছিনা। কারণ একটাই দোষটা তো আবিষ্কারকের না দোষটা ব্যবহার কারীর।
দেশে যথেষ্ট পরিমাণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ সৃষ্টি করতে না পারা রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা। সরকার যেখানে ব্যর্থ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে সফল। এ জন্য সরকার শিক্ষার ওপর ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য করছে। এ পদক্ষেপ দেশকে মেধাশূণ্য করার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সেই বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবদান ছিল। আজও আমরা এত এত আন্দোলন করতেছি এই আন্দোলন কারও বিরুদ্ধে নয়। এই আন্দোলন আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আজ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশে এবং দেশের ভিতরে যে অর্জন করতেছে তা সত্যিই ঈর্ষণীয়ও বটে।
বিশ্বের ২৫টি দেশের এমনই ৮০ জন শিক্ষার্থীকে এক বছরের বৃত্তি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ছিলেন চারজন। সদস্যদের মধ্যে হলেন চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনের স্নাতক সায়মা সুলতানা।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের এ ফারজানা মুবারক কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছেন ‘চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল’ পুরস্কার।
এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই প্রথম রোবট আবিষ্কার করেছিল। এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ গুগল, টুইটারসহ বিভিন্ন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর যে ভ্যাট আরোপ করেছে তা নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীরা আজ চোখে সর্ষে ফুল দেখছে।
কারণ এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০শতাংশ শিক্ষার্থীই দরিদ্র ঘরের সন্তান।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আজ আমরা চারিদিকে চরম হতাশা দেখতেছি। দোকানে নাস্তা করার পর যখন এক টাকা ভাংতি নাই বলে দোকানদার পরে নিতে বলে তখন আমরা একটা চকলেট নিয়ে আসি বা কিভাবে ঐ এক টাকা নিয়ে আসা যায় তার ফন্দি বের করতে মশগুল হয়ে যাই। সেই হিসাবে আমরা একশ টাকায় কিভাবে সাড়ে সাত টাকা দিব আপনিই বলেন।
সবশেষে আপনার কাছে একটু বলতে চাই আমাদের উপর থেকে অনাকাঙ্কিত এবং অবৈধ ৭.৫% ভ্যাট আরোপটা তুলে নিতে সহায়তা করবেন বলে আসা রাখি।
ইতি
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অভাগা ছাত্র
মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন রকি
শিক্ষার্থী
বি, জি, সি ট্রাষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply