থেসালি
থেসালি নগরীর উপকণ্ঠে, ঈজিয়ান সাগরের
তীরে একদা রোদ পোহাচ্ছিল একিলিস। মনটা
বেশ ফুরফুরে তার, টানা সপ্তম বারের মতো
অলিম্পিক দৌঁড়ে জিতেছে কিছুদিন আগে, জলপাই
পাতার মুকুটটি তরতাজা এখনও। ঠোঁটের কোনে
তার প্রাচীন গ্রিক সঙ্গীতের গুনগুন,
মাঝেমাঝে সে নেড়েচেড়ে দেখছে
জলপাতার মুকুট। এমন সময় পণ্ডিত চেহারার এক
কচ্ছপ এসে হাজির হল তার কাছে।
“কী চাস?” অবজ্ঞাভরে তাকায় একিলিস। মেজাজ
খানিকটা চড়ে উঠে তার, কচ্ছপ ব্যাটা রোদটা
একেবারে আড়াল করে ফেলেছে।
“তোমাকে নাকি সবাই ক্ষীপ্র পায়ের একিলিস,
Achilles of the nimble feet, বলে?”
“তো?” চোখের ভ্রু’র পেশীগুলি নড়েচড়ে
উঠে একিলিসের।
“তারা ভুল বলে,” কচ্ছপের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।
“আমি তোমাকে দৌড়ে হারিয়ে দিতে পারি।”
“তাই নাকি?” মেজাজ বেশিই খারাপ হ্য় একিলিসের।
ইচ্ছা করে বেয়াদব কচ্ছপটির গালে একটি চড়
লাগিয়ে দিতে।
“হ্যাঁ, যদি তুমি আমাকে একটু আগে থেকে শুরু
করতে দাও আর কি।”
“কতটুকু চাস?”
“এই, ধরো, ১০ হাত।”
“তোকে আমি এক নগর আগে থেকে দিতে
পারি।”
“না না, কী বলো! অতটা লাগবে না।” বিনয় ঝরে
পরে কচ্ছপের চেহারায়। “১০ হাতই যথেষ্ট আমার
জন্য।”
“চল তাহলে, শুরু করি।”
“আচ্ছা একিলিস, তোমার তো, যতদূর জানি, বুদ্ধিশুদ্ধি
ভালোই আছে, আর গণিতও তুমি জানো মোটামুটি”
গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়ে গেছে, এমন ভাব
করে কচ্ছপ বলে। “খামোখা আমরা না দৌঁড়ে, যুক্তি
দিয়ে প্রমাণ করে দিচ্ছি যে তোমাকে আমি
হারাতে পারি। ঠিক আছে?” কচ্ছপের স্বরে একটু
খোঁচা মনে হলো।
“আচ্ছা, দেখা।” রেগে যায় একিলিস।
“ধরো, তুমি আমাকে ১০ হাত অগ্রযাত্রা দিলে। তুমি
কি বলবে যে আমাদের মাঝের এই ১০ হাত তুমি খুব
তাড়াতাড়ি অতিক্রম করে ফেলবে?”
“অবশ্যই, খুব দ্রুত।” একিলিসের ঝটপট জবাব।
“এবং এই সময়ে, তোমার কী মনে হয়, আমি
কতটুকু এগিয়ে যাব?”
“হয়তো ১ হাত, তার বেশী নয়।” এক মুহূর্ত চিন্তা
করে বলে একিলিস।
“খুব ভালো,” উত্তর দেয় কচ্ছপ। “অতএব
আমাদের মাঝে এখন ১ হাত দুরত্ব। আর এই ১ হাত
তুমি খুব দ্রুত অতিক্রম করে ফেলবে, তাই না?”
“আসলেই খুব দ্রুত অতিক্রম করে ফেলব।”
“তা সত্ত্বেও, এ সময়ে আমি তো আর বসে
থাকব না, আরো একটু এগিয়ে যাব। আর এর ফলে
তোমাকে ঐ নতুন দূরত্বটুকুও যেতে হবে, তাই
না?”
“হ্যাঁ,” একটু আস্তে আস্তে বলে একিলিস।
“এবং তুমি যখন আমাকে ধরতে আসছ, তখন আমি
আরো একটু এগিয়ে যাব, আর এর ফলে প্রতিবার
আমাকে নতুন জায়্গায় ধরার চেষ্টা করবে।” ক্চ্ছ্প
মসৃণভাবে বলে। একিলিস চুপ।
“তাহলে তুমি দেখো, প্রতি মুহূর্তে তোমাকে
আমাদের মাঝের দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে,
এবং সে সময়ে আমিও তোমার জন্য নতুন দূরত্ব
যোগ করতেই থাকব। প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি
ঘটতেই থাকবে, কখনো শেষ হবে না, যাকে
বলে একেবারে অসীমসংখ্যক (infinity) বার।
দূরত্ব, তা যতই ছোট হোক না কেন, সে দূরত্ব
তোমার সামনে থেকেই যাবে।” দাঁত বের করে
হাসে কচ্ছপ।
“তাই তো দেখি।” আমতা আমতা করে একিলিস।
“আর তাই তুমি কখনো আমাকে ধরতে পারবে না,”
সহানুভূতির স্বরে বলে কচ্ছ্প।
ক্ষীপ্র পায়ের একিলিস, অলিম্পিকের মাঠে
জিউসের হাত থেকে জলপাই পাতার
মুকুটগ্রহণকারী একিলিস, ভেঙে পড়ে
একেবারে। ঈজিয়ানের মর্মর ধ্বনি ছাড়া কয়েক
মুহূর্ত আর কোনো শব্দ শোনা যায় না।
লম্বা গলা বাড়িয়ে একিলিসের পিঠ স্পর্শ করে
কচ্ছপ, সমবেদনার স্বরে বলে, “বুঝলে, একিলিস,
হাঁটুর বুদ্ধির চেয়ে মাথার বুদ্ধি বেশি কাজের জিনিস।
তবে হতাশ হয়ো না, একজনের ঠিকানা দিচ্ছি
তোমাকে। এঁর কাছে যাও, অসীম-এর ব্যাপারে
ভালো কিছু বিদ্যাশিক্ষা হবে তোমার, আশা করি।
ঝিনুকের খোলে গোটা গোটা করে ঠিকানা
লিখে কচ্ছপ: জেনো, এলিয়া নগর । ঠিকানা
পেয়েই এলিয়া’র উদ্দেশ্যে দৌঁড় শুরু করে
একিলিস।
এথেন্স
আনাতোলিয়া (Turkey) ভূখণ্ডের আয়োনিয়ান
গ্রিকরা পারস্যরাজের তাড়া খেয়ে দশ বছর ঘুরে
বেড়ায় ঈজিয়ান সাগরে, তারপর একদিন বসত গেড়ে
এই এলিয়া নগরে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে
এলিয়ার প্রাণচাঞ্চল্য, গড়ে উঠে সক্রেটিসপূর্ব
যুগের দর্শনের শক্তিশালী এক ধারা, এলিয়াটিক
স্কুল। এলিয়াটিকরা বিশ্বাস করত, “জগতে সবকিছুই
আসলে এক, কিন্তু মানুষের ইন্দ্রিয় জগতের
ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণা দেয়। গভীর চিন্তাভাবনার
মাধ্যমেই কেবল ইন্দ্রিয়ের ভ্রান্তি এড়িয়ে মানুষ
পেতে পারে পরম সত্যের সন্ধান।”
পারমেনাইদেস (Parmenides) প্রতিষ্ঠা করেন
দর্শনের এ ধারাটি, জেনো (Zeno) তার সুযোগ্য
শিষ্য ও প্রচারক।
এলিয়া নগরে এসে একিলিস শুনতে পায় এক মাস
পূর্বেই এথেন্স চলে গেছেন জেনো;
সাথেসাথেই ফিরতি পথে এথেন্সের রাস্তা ধরে
সে। আগে জানলে অবশ্য অনেকটা পথ কমে
যেত, কিন্তু জীবনে এই প্রথম বার একিলিস জানার
রোমাঞ্চকর আনন্দ অনুভব করতে লাগল।
অ্যাগোরায় বিতর্ক ভাষণ শেষে তার চত্বরে
আগুনের কুণ্ডলী জ্বালিয়ে খোলা আকাশের
নিচে বসে আছেন জেনো, বৃদ্ধ গুরু
পারমেনাইদেস ঘুমিয়ে পড়েছেন অনেক ক্ষণ।
এথেন্সবাসীদের সাথে দীর্ঘ আলোচনায়
ক্লান্ত আনন্দময় কেটেছে সারা দিন।
এথেন্সের সক্রেটিস ছেলেটি জেনোর মwww.lekhok.xyz
Leave a Reply