গ্রামের লোকেরা সকালে ঘুম ভেঙে দেখতে পায়, তাদের আঙিনায় হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছেন পলান সরকার। তাঁর কাঁধে ঝোলা, ঝোলার ভেতরে বই। বয়স ৯৪ বছর, কিন্তু ৩০ বছরের যুবকের মতো সচল। কাঁধে ঝোলা নিয়ে প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে গ্রাম-গ্রামান্তরে যান। নিজের টাকায় কেনা বই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে পড়তে দেন। পড়া শেষ হলে দিয়ে আসেন নতুন কোনো বই। এভাবে একটানা ৩০ বছর ধরে করছেন এই কাজ। রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় ২০টি গ্রামজুড়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বই পড়ার এক অভিনব আন্দোলন।
প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। গ্রামাঞ্চলে এখনো বহু মানুষ দরিদ্র ও নিরক্ষর। নিজের ও আশপাশের গ্রামগুলো থেকে অশিক্ষা ও অজ্ঞানতা দূর করার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছেন পলান সরকার।
বাবাকে পলান সরকার হারিয়েছিলেন পাঁচ মাস বয়সে। পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয়েছিল বটে, কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির পর অর্থাভাবে আর পাঠশালায় যেতে পারেননি। তবে পড়ার অভ্যাসটা থেকে গিয়েছিল। গ্রামগঞ্জে বইয়ের বড্ড আকাল। এর-ওর কাছ থেকে ধার করে এনে বই পড়তেন। যখন যে বই পেয়েছেন, সাগ্রহে পড়েছেন। দারিদ্র্যভরা শৈশবের পরে উত্তরাধিকারসূত্রে মাতামহের কাছ থেকে কিছু জমিজমা পেলে তাঁর দারিদ্রে্যর তীব্রতা কমে। বিয়ে করে আর দশজন মানুষের মতো সংসারী হন তিনি। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন জেগে থাকে।
যৌবনে পলান সরকার ভিড়েছিলেন যাত্রাদলে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে অভিনয় করতেন ভাঁড়ের চরিত্রে। বিস্তর লোক হাসাতেন। সেকালে যারা যাত্রাপালা করত, তাদের মধ্যে লিখতে-পড়তে জানা মানুষের বড্ড অভাব ছিল।
তখন না ছিল ফটোকপিয়ার, না সাইক্লোস্টাইল মেশিন। তাই যাত্রার পাণ্ডুলিপি কপি করতে হতো হাতে লিখে। পলান সরকার এ কাজ করতেন। পাশাপাশি তাঁকে প্রম্পটও করতে হতো। এভাবেই তাঁকে বই পড়ার নেশা পেয়ে বসে।
পলান সরকার বড় হয়েছেন মামাবাড়িতে। মাতামহের জমির খাজনা আদায়ের কাজ করেছেন একসময়। ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) কর আদায়কারীর চাকরিও করেছেন কিছুদিন। বেতনের টাকায় বই কিনতেন। নিজে পড়তেন, অন্যদেরও ধার দিতেন। তারপর নিজের গ্রামে নিজের বসতভিটায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। শুরুতে তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বই পড়তে দিতেন। প্রতিবছর যাঁরা মেধাতালিকায় প্রথম থেকে দশম স্থান পর্যন্ত অর্জন করত, তাদের প্রত্যেককে উপহার দিতেন বই। তাঁর বই বিতরণের আন্দোলনের সে–ই ছিল বীজ।
ডায়াবেটিসের কারণে এ সময়ে পলান সরকারকে হাঁটার অভ্যাস করতে হয়। তখন তাঁর মাথায় হঠাৎ এক অভিনব চিন্তা আসে। ‘আমি ভেবে দেখলাম, যারা আমার বাড়ি থেকে বই নিয়ে যায়, আমি নিজেই তো হেঁটে হেঁটে তাদের বাড়িতে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি।’ বলেন পলান সরকার। ‘সেই থেকে শুরু। এক বাড়িতে বই দিতে গেলে তার দেখাদেখি আরেক বাড়ির লোকেরাও বই চায়। বই নিয়ে হাঁটা আস্তে আস্তে আমার নেশায় পরিণত হলো।’
পলান সরকার যেতে শুরু করলেন গ্রামে গ্রামে, মানুষের ঘরে ঘরে। তাঁর বই বিলি করার গল্প ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রছাত্রী ও গৃহবধূরা বই ধার নিতে তাঁর কাছে ধরনা দিতে শুরু করেন। গ্রামের পথে পথে তিনি ঘুরতে শুরু করেন ভ্রাম্যমাণ এক পাঠাগারের মতো। নিজের গ্রামে তাঁর বাড়িটিই হয়ে ওঠে পাঠাগার।
পড়তে দেওয়ার জন্য বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদি লেখকদের বইগুলো রয়েছে পলান সরকারের সবচেয়ে পছন্দের তালিকায়। তা ছাড়া লোকসাহিত্যসহ অন্যান্য জনপ্রিয় লেখকের বইও তিনি বিতরণ করেন।
পলান সরকারের হাত ধরে ৫৫ বছর বয়সী আবদুর রহিম হয়ে উঠেছেন বইয়ের নিয়মিত পাঠক। বাঘা উপজেলার দিঘা বাজারে রহিমের মুদির দোকান রয়েছে। এখন তিনি শুধু নিজেই বই পড়েন না, প্রতি বিকেলে তাঁর দোকানে বসে বই পড়ার আসর। আবদুর রহিম বলেন, পলান সরকার তাঁর ভেতরে বইয়ের আলো জ্বেলে দিয়েছেন।
পলান সরকারের বই পড়া আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মধ্যে। ওই নিভৃত পল্লি অঞ্চলের বাইরে সে খবর কেউ জানত না। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চারদিকে তাঁর প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে স্থানীয় জেলা পরিষদ তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রের বিশেষ সম্মান একুশে পদকে তাঁকে ভূষিত করা হয়।
৯৪ বছর বয়সেও পলান সরকার বই নিয়ে প্রতিদিন দু-তিনটি গ্রামে যান হেঁটে। সুরসিক ও জীবনবাদী মানুষ তিনি। মানুষের মধ্যে তিনি এমন উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছেন যে তাঁকে ঘিরে দেশের উত্তরাঞ্চলে বই পড়া একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। তাঁর এই আন্দোলনের গভীর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর নিজের ও আশপাশের গ্রামগুলোর সীমানার বাইরে। অনেকেই এখন এগিয়ে এসেছেন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা এবং গ্রামে গ্রামে বই বিতরণের আন্দোলনে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের অশিক্ষার অন্ধকারে পলান সরকার হয়ে উঠেছেন উজ্জ্বল এক প্রদীপের মতো।
মূল লেখকঃ
প্রথম আলোর ছুটির দিনে পূর্বে প্রকাশিত
Leave a Reply